০২:০৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

গল্প : ‘কালো ডানায় বাসররাত’

  • নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট: ০৮:৩৭:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ১১২

(দুটি কাক, দুটো সাবান আর এক কিশোরের হাতে ইটের ঢিলা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। গল্পটা শুরু হয় হালকা কৌতুকে, কিন্তু হঠাৎ করেই জীবন ছুঁয়ে ফেলে এক ভয়াবহ সত্য ঘটনা। কাকের সাবান চুরি যেন হয়ে ওঠে এক নির্মম নিয়তির ফাঁদ। অজান্তেই ছুঁড়ে দেয়া এক টুকরো ইট ভেঙে দেয় এক ষোড়শীর শরীরের শান্তি।
আর ইমামের চোখের সামনে খুলে যায় রক্তমাখা বাস্তবের দুয়ার। এই গল্পে আছে হাসি, আছে হাহাকার, আছে কৈশোরের নির্দোষ দৌড় আর অপ্রত্যাশিত পরিণতির শিহরণ। “কালো ডানায় বাসররাত” শুধু কাকের গল্প নয়- এ এক অদৃশ্য ছায়া, যে ছায়া আমাদের জীবনের অপ্রত্যাশিত রাতগুলোতেও ডানা মেলে।)

এম দিলদার উদ্দিন

কাকের ডাক কানে এলে কারই বা ভালো লাগে!
সারাক্ষণ কানের কাছে কা-কা শব্দে আকাশ মাথায় তুললে মন অকারণে তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। হয়তো এজন্যই বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- কাকস্য পরিবেদনা অর্থাৎ কাকের আর্তনাদ।

কালো রঙের এই পাখির গলা অদ্ভুত ধূসর আভায় মিশে থাকে। তার চোখ দুটো ছোট অথচ তীক্ষ্ণ, ঠোঁট ধারালো, পা শক্ত। দল বেঁধে চলাই তাদের স্বভাব। শত্রুর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে কাকের জুড়ি মেলা ভার। একটা কাক আহত হলে কিংবা মারা গেলে পুরো পাড়া কেঁপে ওঠে- ডানায় ঝড় তোলে তারা, শোক আর প্রতিবাদ মিলেমিশে কালো মেঘের মতো নেমে আসে আকাশজুড়ে।

কাক নিয়ে যেমন লোকমুখে তাদের বুদ্ধিমত্তার গল্প ছড়িয়ে আছে, তেমনি বোকার পরিচিতিও কম নয়। বলা হয়, কাক যখন খাবার চুরি করে লুকোয়, তখন নিজের চোখ বন্ধ করে ভাবে কেউ দেখেনি। অথচ পরে সেই লুকোনো জিনিস নিজেই খুঁজে পায় না।
কাকের এই ধুরন্ধর অথচ বোকামিপূর্ণ স্বভাব এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করে- স্মার্ট না বোকা, কোন দিকেই বা তার আসল পরিচয়?

তবুও মানুষ কাককে ভাল চোখে দেখে না।
কারণ এর কীর্তি কম নয়-
রোদে শুকানো মাছ বা মশল্লা হোক, খাবার বা সাবান হোক, হাস-মুরগির ছানা হোক- সবই ওরা সুযোগ পেলে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। গৃহস্থের শান্তি নষ্ট করা যেন ওদের জন্মগত দায়িত্ব। এরা কখনও সঙ্গী হয় না, বরং বিপদে ঠেলে দেয় মানুষকে।

হয়তো এজন্যই বহুজন মনে করে, কাকের ডাক অশনি সংকেত বয়ে আনে। আর সত্যিই, কাকের সেই ডাকই একদিন চরম বিপদের বার্তা হয়ে নেমে এসেছিল ইমাম হোসেন ইমুর ছাত্রজীবনে।

ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে পুকুরে গোসল ছিল ইমাম হোসেনের নিত্য দিনের রুটিন। দশম শ্রেণির ছাত্র সে- চোখেমুখে নিষ্পাপ সরলতা, আবার দুষ্টামির ছাপও কম নয়।
পুকুর ঘাটের জন্য বাঁশের খুঁটির উপর আট ইঞ্চি চওড়া আর দশ–বারো ফুট লম্বা দুইটি তক্তা জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এক ধরনের মাচা। গোড়ায় গেঁড়ে রাখা কাঠির উপর ঝোলানো থাকত গামছা কিংবা শুকনো কাপড়।

সেদিন দুপুরেও যথারীতি ইমাম পুকুরে নামে। ঘাটে রাখা সাবানদানীতে একটি বাংলা সাবান আর একটি চকচকে কসকো সাবান রেখে বুকসমান পানিতে সাঁতার কেটে কয়েকবার ডুব দিয়ে ফেরে ঘাটে। কিন্তু এসে দেখে- সাবানদানী ঠিক জায়গায় আছে, অথচ সাবান দুটি নেই!

চোখ কচলে অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল সে। কেউ নেই। হঠাৎ দূরে করই গাছের মগডালে চোখ আটকে গেল- দুটি কাক ঠোঁট দিয়ে সাবানগুলোকে ঠুকরে খাচ্ছে। দুই পায়ে শক্ত করে চেপে ধরে সাবান গিলছে যেন মন ভরে রসনা তৃপ্ত করছে।

ইমামের মাথায় রক্ত উঠে গেল। “ওরে কাকচোর!” -মনে মনে বলল। তারপর পুকুর থেকে উঠে কয়েকটি ইটের টুকরা হাতে তুলে কাকের দিকে ছুঁড়ল। কাক দুটি সাবান মুখে নিয়ে উড়ে গেল পাশের আরেকটি বাড়ির পুকুরপাড়ে। ইমাম এবার দৌড় শুরু করল- “আজ আর সাবান ছাড়ব না, মা-বাবার বকুনি থেকে রক্ষা পেতে হলে সাবান নিয়েই ঘরে ফিরতে হবে।‘’

হাঁপাতে হাঁপাতে ইমাম এসে যা দেখল, তাতে তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়!
বড় এক গাছের ডালে বসে এক কাক আরামে কসকো সাবান চিবুচ্ছে। ঠিক তার পাশেই আরেক কাক বাংলা সাবান নিয়ে ব্যস্ত। যেন দু’জন দম্পতি একসাথে খাওয়াদাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

কাকদুটো শুধু সাবান খাচ্ছেই না, নাটকও করছে।
একবার ঠোকর দিল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বামে তাকাল। আবার ঠোকর, এবার ডানে তাকাল। তারপর নিচে ঝুঁকে মুখে কী যেন বিড়বিড় করছে।

ইমামের মনে হলো, ওরা যেন বলছে-
খাবি… খা… খাবি… খা

মানে, “আমরা তো খাচ্ছি, তুইও আয় ভাই, সাবানের ভোজ শুরু হয়ে গেছে!”

এ দৃশ্য দেখে ইমামের মাথা একেবারে গরম হয়ে গেল।
সে গালি ছুঁড়ে বলল-
“এই শালার কাকচোরা! আমার সাবান চুরি করে খাচ্ছিস, আবার আমাকে দাওয়াতও দিচ্ছিস? হালারপুত, তোরে তো আজ ছাড়ছি না!” বলেই সে একটা ইট তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারল।

সাবান দুটির একটি কাকের মুখ থেকে ছিটকে পুকুরের পাড়ে গিয়ে পড়ল। অপর সাবানটিসহ কাকগুলো উড়ে চলে গেল, কিন্তু ঘটনাটা এখানেই শেষ হলো না।

কারণ- যেখানে ঢিল পড়েছে, সেখানে ঘটছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। পুকুরের ঘাটে তখন গোসল করছিল এক ষোড়শী। তার শরীরে তখন সাবান মাখাচ্ছিল ভেজা আধভেজা ঢঙে। অথচ ইমামের মন তখন কেবল কাকের সাবান গেলা, সাবান উদ্ধার জন্য তার লড়াই আর সাবান না নিয়ে ঘরে ফেরার অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্ভাবনায় আটকে আছে। ফলে মেয়েটির নগ্ন দেহ, দুলতে থাকা চুল, এবং দেখার আখাংকা- সবকিছু তার নজর এড়িয়ে গেল।

এটা হয়তো তার জন্য বিপদের এক অদৃশ্য প্রাকৃতিক মঞ্চ। ইমাম বুঝতে পারল না, কাকের সাবান চুরি- আজ তাকে এমন এক মুহূর্তে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। অথচ তার চোখ পড়ে ছিল কেবল কাকের দিকে।

কাককে ছোঁড়া ঢিলটি গিয়ে পড়ল সরাসরি মেয়েটির পিঠের নিচে- নরম মাংসে। ধারালো ইটের আঘাতে তীব্র ব্যথায় মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল।

ইমাম যেন একেবারে থ হয়ে গেল। চোখের সামনে পুরো দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে।
সাবান হারানোর দুঃখে সে যতটা না শক পেয়েছিল, তার চেয়ে শতগুণ বেশি শকে ডুবে গেল এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখে। মনে হলো- কাকের সাবান চুরি শুধু নয়, আজ তাকে এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের মুখে ঠেলে দিল, যার ব্যাখ্যা দেয়া তো দূরের কথা- নিজেকেই সামলাতে পারছে না।

মেয়েটির চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে গেল। কে ঢিল ছুঁড়েছে তাকে ধরার জন্য পুকুর পাড়ের  দিকে দৌড়ে এলো বাড়ির লোকজন, ইমাম ভয়ে অচেতন- ধরা পড়ার ভয়ে শরীরটা কাঁপতে লাগল। অর্ধ কিলোমিটার দৌড়ে সে রাজাশাইল ধানক্ষেতে ঢুকে পড়ল। আটপৌরে গরম, ফসল গোড়ায় কাই কচড়ে মাটি। সে দৌড়ে গিয়ে ধানগাছের একটা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পড়ল। মাটির কাদা মেখে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।

কানে তখনও ভিড়ের হৈচৈ ভেসে আসছে- দৌড়ে আসা মানুষের গলা। কেউ ব্যস্ত গলায়- বেয়াদপটা পালাল কোথায় ?

কারো কারো গরম গলায়-
“ধর ধর শালারে ধর!”
“তুই এদিকে যা, আমি ওদিকে দেখছি!”

শব্দগুলো কাছাকাছি এলো, ইমামের কানে তা যেন ক্রমে বড় হয়ে তার কানের পর্দায় বেজে উঠেছে- মনে হচ্ছে ওরা তার কাছাকাছি চলে এসেছে। এ বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছে।

ইমাম মিয়া বাড়ির ছেলে। যারা তাদের পরিবারের মুরুব্বীদের সব সময় সন্মান দিয়ে চলে আসছে এবং তাদের কাছ থেকে জমি কিনে মেঘনার ভাঙ্গন কবলিত এলাকা হাতিয়ার উত্তরাংশ থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছে- আজ তাকে হয়তো ওদের হাতেই মার খেতে হবে। সে ধান খেতের ভিতর একদম স্থির হয়ে শুয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ তার মনে এক ভাবনা বেজে এলো- ‘’আমি না বুঝে কত বড় অপরাধটা করে ফেললাম?’’ মাঠের ভেতর থেকে ইমাম শুনে- কেউ একজন বলছে, “এত বড় বিশাল ধান ক্ষেত, শয়তানটাকে খোঁজে পাব বলে মনে হয় না। চল, ঘরে ফিরি; কাকলিকেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওর পাছায় রক্ত ঝরছে, সেলাই দিতে হবে। দেরী করা ঠিক হবে না।”

কাকলি নামটা কানে আসতেই ইমামের শরীরটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর যেন হঠাৎ বজ্রপাত হলো। এ তো সেই কাকলি! ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে একসাথে ক্লাসে বসে আসছে তারা। কতদিনের পরিচয়, কতদিনের একসাথে পড়া, হাসি-আড্ডা। এখন তারা দশম শ্রেণীতে। কাকলির বাড়ি ছৈয়দিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে রেহানীয়া গ্রামে। এতদূরের পথ হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে আসা সম্ভব নয় বলে সে খালুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে।

ক্লাসের ভেতরে ইমামের দৃষ্টি যতবারই কাকলির দিকে গিয়েছে, ততবারই তার মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন উঠেছে। লাজুক অথচ চঞ্চল মেয়ে কাকলি- যার হাসি সবার মাঝে আলো ছড়াতো। সেই কাকলিকে ইমাম নীরবে ভালবাসতে শুরু করেছে তিন মাস হলো। একতরফা প্রেমের সেই বীজ তার বুকের ভেতর এমনভাবে শেকড় গেঁথেছে যে, প্রতিদিন সে নতুন করে স্বপ্ন আঁকত- কোনো একদিন মুখ ফুটে বলবে, “কাকলি, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।”

কিন্তু আজ, সেই স্বপ্ন যেন রক্তে ভেসে গেল। কাকের দিকে ছুঁড়ে মারা তার হাতের ইটের টুকরা গিয়ে আঘাত করেছে কাকলির পিঠের নিচে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার জামা। ব্যথায় কাকলির চিৎকার এখনও ইমামের কানে বাজছে। অথচ সেই আঘাতের উদ্দেশ্য ছিল না কাকলি- ছিল সেই ধূর্ত কাক।

ইমামের বুকের ভেতর অপরাধবোধের ঝড় বয়ে গেল। যাকে সে মনের গভীরে নিভৃতে পূজা করেছে, যাকে নিয়ে অগণিত কল্পনা বুনেছে, তাকেই সে আজ রক্তাক্ত করেছে! কী করে সে কাকলির সামনে দাঁড়াবে? যদি কাকলি জেনে ফেলে যে, এই আঘাতের নায়ক ইমাম নিজেই, তাহলে কি আর কখনো তার চোখের দিকে তাকাবে?

মুহূর্তেই মনে হলো, সবকিছু শেষ হয়ে গেল। তার বুকের গভীরে জমে থাকা সেই মধুর ভালবাসা কি এখন আর মুখে আনা সম্ভব? আজ যদি সে বলে, “কাকলি, আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি”- তাহলে কাকলি কি শুনবে? নাকি সে চোখ ফিরিয়ে নেবে, মুখ ঘুরিয়ে দেবে, আর ইমামের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে দেবে?

ইমাম বুঝল, এ শুধু একটা ইটের টুকরো নয়- এ যেন তার ভালবাসার পথে পড়ে থাকা এক বিশাল পাথর, যা হঠাৎ করেই সব স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।

ইমামের চোখ জোরে মেজাজি হয়ে উঠল- লোকগুলো ফিরে যাচ্ছে, মর্মে সে বুঝল। একটু চেক দিতে চেয়েই মাথা কুঁচকে, যেন কারো নজর এড়িয়ে, সে সাবধানে মাথা উঁচু করে চারপাশে তাকাল। ধানক্ষেত- সোনালি-সবুজ ঢেউয়ের মত মৃদু নড়াচড়া করছে; কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পাশে পাশে কোনো সাড়া–শব্দ নেই। কিশোরদের কোলাহল এখন দূরে; কৌতুক আর আড্ডার গন্ডি ছেড়ে সবাই যেন ফিরে গিয়েছে, নীরবতা আবার ধানচর জুড়ে ঢুকে পড়েছে।

হাওয়ার মিষ্টি ঝাপটা গলায় লাগল- পায়ের তলায় মাটি খানিক কচিকচ করে। ইমামের মনে হলো, পৃথিবী তারই জন্য কমে এসেছে; ধানগুলোর মাঝেই যেন এখন শুধু সে আর তার অপরাধ রয়ে গেছে। নিজের বিবেককে সে কাঁধে তুলে এনে কোন রকম প্রশ্ন ছুঁড়ল- স্বরে নয়, মনে: “এই এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত, ওই ইট ছোঁড়া, কি কিনা সারাজীবন আমাকে তাড়া করে বেড়াবে?” শব্দটা জোরে উচ্চারিত না হলেও ভাবের তীব্রতা কাঁটা জাগাচ্ছিল।

সে মনে করার চেষ্টা করল- কী ছিল কারণ? ক্ষোভ? কৌতুক? নাকি শুধু অমিত সাহসবিহীন একটি হাসি? ওই ইট ছোঁড়াটা যেন এখন একটি কণ্ঠরোধী রেকর্ড- বার বার প্লে হচ্ছে তার মনের ভিতরে। প্রতিটি ফ্রেমে দেখা যায় কাকের পাখা, সাবান, কাকলির সোনালি রং, ও তারপর- রক্ত ও চিৎকার।

ইমামের গা কাঁপছে, কিন্তু তা শুধু শারীরিক কাঁপন নয়; তা ছিল লজ্জা আর অপরাধবোধের কাঁপুনি। সে দেখতে পেল- তার এ ভুল সিদ্ধান্তের ফলাফল কেবল একটি সরল ঘটনা নয়; তা মানুষকে ধাক্কা দেওয়ার মতো একটি ঝলকানো আঘাত, যা কাকলির শান্ত মনকে চিরতরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করলেই ইমামের মনে ভেসে উঠছিল- কাকলির রক্তে ভেজা কাপড়, চারপাশের বিরক্তিকর শব্দ, আর নিজের সেই হাত, যেটা দিয়ে সে ইট ছুঁড়েছিল। সবকিছু যেন একসাথে ফিরে এসে তাকে তাড়া করছিল।

ধীরে ধীরে সে ধানের সারিতে পায়ের নীচে কাঁচা মাটি ছুঁয়েই হেঁটে গেল। প্রতিটি পায়ের চিহ্ন যেন অশান্তি আর অনুতাপের চিহ্ন ফেলছে ধান ক্ষেতের জমিতে। সে জানে- এখানে দাঁড়িয়ে আর কী করা যায়? এই জমি কখনো ক্ষমা সইবে না; মানুষের মনে যে ক্ষত হয়েছে, সেটার ক্ষত আর মাটির উপর পড়া চিহ্নে মিলিয়ে ফেলা যায় না।

তবু বাঁচতে চাওয়ার একটা তাগাদা ছিল- এটা কেবল লজ্জা নয়; মনে একটা জরুরি সংকেতও ডাকছিল। ইমাম বুঝে গেল, গোপনে লুকিয়ে থাকলে কোনো উপায় নেই, এখনি কাকলি আর তার পরিবারে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। যদি সে চुप থেকে যায়, দোষ-দাম চুকাতে হবে পরে আরও কঠিনভাবে। সময় তার পক্ষে নেই।

তার মনে এক অদ্ভুত ভীতিও কাজ করছিল- যতক্ষণ সে চুপ থাকবে, ততক্ষণ তার ভেতরের ভালোবাসা বিষে পরিণত হবে; আদর্শ, সুন্দর কথাগুলোই ধীরে ধীরে টক হয়ে যাবে। তাই এখনই ইমামের করণীয় একটাই: সাহস করে ও কুক্ষিগত লজ্জা ভেঙে কাকলির কাছে এসে ক্ষমা চাওয়া, নিজের ভুল মেনে নেওয়া এবং যা করণীয় সেটা করা- চাইলে বাড়তি সাহায্য করা, চিকিৎসা করায় বা ক্ষতটুকু সারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। এসব না করলে, পরেও তার আত্মা শান্তি পাবে না; তবে সামনাসামনে ক্ষমা চাইলেই হয়তো সম্পর্কের ভাঙা টুকরো জোড়া লাগার সুযোগ পাওয়া যাবে।

নীরব ধানক্ষেতের মাঝেই, সূর্য অস্তমিত আকাশের লালছায়ায়, ইমাম বুঝল- অপরাধের ওজন তাকে ভেঙে ফেলতে পারে, কেবল ক্ষমার রাস্তাই হারানো সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনতে পারে। হৃদয়ের অন্দরে সে ধীরে ধীরে এক সংকল্প তৈরি করল; যা ছিল তৎক্ষণাত আর কৌতুকসুলভ, তা এখন জীবন হিসেবে ধরা। আজ যে ভুলটা করেছে, তার দায় নিতে হবে- চোখে চোখ রেখে, গলা কাঁপতে-কাঁপতে, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিলিয়ে।

সে ধানক্ষেত ছেড়ে হাঁটতে লাগল- প্রতিটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, যেন ভবিষ্যৎকে সে টানছে, অথচ একই সঙ্গে সেই ভবিষ্যৎ থেকে পালাচ্ছে। মনে করিয়ে দিল- কখনো ছোট একটি কাজই বড় মর্মান্তিক প্রভাব ফেলে। ইমাম জানে আজকের রাত তার জীবনটা বদলে দেবে – এখন থেকে কী করবে তা নির্ভর করবে তার ওপর: সে কি কাকলির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে না লজ্জায় চুপ করে থাকবে, নীরবতা বজায় রাখবে না সত্যি কথা স্বীকার করবে।

তবু সেই মুহূর্তে ভেতর থেকে এক ছোট্ট আশা জাগল-  মানুষ প্রথমে রাগ করে, কিন্তু পরে সেটা মেনে নেয় আর শান্ত হয়। আহত মেয়েটির প্রতিক্রিয়া, হাসপাতালের শীঘ্রই আগমন- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হতে শুরু করল। ইমাম বুঝতে পারল, লোকজন মারধরের চেয়ে কাকলির চিকিৎসা চাইছে; আর হয়তো এজন্য উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত হতে লাগল। সেও বাঁচল- কিন্তু বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতরে জন্ম নিল তীব্র অনুশোচনার খাদ।

সে বেশি কিছু না ভেবে ধানের কুঁড়ি আর মাটির গন্ধে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলল। চোখের পানি ছিল শুধু দুঃখের নয়, নিজের ভুল আর অন্যায়ের ভারেও ভরা। সে বুঝতে পারল, এই ভুল শুধু আজ নয়- তার পুরো জীবনকেই বদলে দেবে।

এরপর যা হলো- গ্রামবাসী কাকলিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, ইমাম অবশেষে চুপচাপ বাড়ি ফিরল; পথে প্রতিটি পদক্ষেপে যেন তার পা ভারী হয়ে পড়ল। গ্রামের গলি ঘুরতে ঘুরতে ইমাম বুঝল- সেদিন কাকের অপ্রত্যাশিত কাজ আর তার নিজের ভুলের কারণে দুই জনের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- একজন মেয়ের শরীরে আঘাত লেগেছে, আর একজন কিশোরের মনও আহত হয়েছে।

এভাবে, একটি ছোট্ট কাকের কাণ্ড যে এক জোড়া জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে- এ কথাই ইমাম সেই দিন শিখল, আর তার থেকে হারানো নিঃশব্দ বেদনাকে সে আর ফিরে পায়নি।

পরদিন স্কুলে গিয়ে ইমাম অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করল। ক্লাসের বেঞ্চে বসে বারবার চোখ মেলে খুঁজল কাকলিকে- যে মেয়ে সাধারণত প্রথম সারিতে বসে খাতা খুলে পড়াশোনায় মন দিত। কিন্তু আজ নেই। বুকের ভেতর হালকা এক অস্থিরতা জমল। তিন দিন পর টেস্ট পরীক্ষা, অথচ কাকলি নেই! চারদিকে ফিসফিস শুরু হয়ে গেছে- “কাকলি অসুস্থ…”। এই খবর শুনে ইমামের বুকের ভেতর হুড়মুড় করে অপরাধবোধ আরো গভীরভাবে চেপে বসল। সে কাউকে কিছু বলতে পারল না, শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকল।

ক্লাস ক্যাপ্টেন রনিকে সে আস্তে করে প্রস্তাব দিল,
“আমরা কাকলিকে দেখতে যাব? অন্তত তাকে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত।”

রনি প্রথমে একটু চুপ করে থাকল, তারপর রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদা তোলার সিদ্ধান্ত হলো- প্রতি জন দশ টাকা। যারা দিতে পারল না, তাদের জন্য ইমাম নিজের পকেট থেকে দিয়ে চাঁদার প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করল, যেন কেউ বাদ না পড়ে। স্কুল ছুটির পর প্রায় ত্রিশ জন বন্ধু-বান্ধব একসাথে কাকলিদের বাড়ির পথে হাঁটা দিল। হাতে ছোট্ট ঝুড়ি- ফল আর একটা হরলিক্সের জার।

কাকলিদের বাড়ি পৌঁছানোর পর সবাই একটু ইতস্তত করল। দরজার সামনে নীরবতা, মনে হচ্ছিল ঘরটিও যেন কষ্টে নিমগ্ন। কিন্তু ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দৃশ্যটা অন্য রকম হলো। বিছানায় শুয়ে থাকা কাকলি আমাদের দেখে ধীরে ধীরে উঠে বসল। মুখে ফ্যাকাশে ভাব, তবুও এক টুকরো হাসি ফোটাতে চেষ্টা করল। সে হাসি যেন ব্যথার ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এক আলো, যা আমাদের সবার মন মুহূর্তেই হালকা করে দিল।

রনি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“কাকলি, তোমার কী হলো? আমরা সবাই চিন্তিত।”

আমি তখন হঠাৎ বলে উঠলাম,
“মেয়েদের অসুস্থতার কারণ জিজ্ঞেস করা উচিত না।”

কিন্তু কাকলি নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল,
“কাল পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ কোন এক শয়তান আমার দিকে ঢিল ছুঁড়ে। ঢিল গিয়ে সোজা মাঝায় লাগে। চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ঝরে, পরে তিনটা সেলাই দিতে হয়েছে।”

ঘরে নীরবতা নেমে এলো। বন্ধুদের চোখে বিস্ময় আর ক্ষোভ জমে উঠল।
রনি প্রশ্ন করল,
“তুমি তাকে দেখনি?”

কাকলি মাথা নেড়ে বলল,
“না, দেখার সময় পাইনি। ব্যথায় আর রক্ত দেখে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। খালু আর খালা আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। পরে শুনেছি ভাইয়া আর ছোট কাকা শয়তানটার খোঁজে ছুটেছিল, কিন্তু খুঁজে পায়নি।”

এই সময় সানু উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“পরশু টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে তো?”

কাকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল-
“এখনই কিছু বলতে পারছি না। সুস্থ না হলে খালু হেডস্যারের সঙ্গে আলাপ করে বিকল্প পথ খুঁজবে। নইলে অসুস্থ শরীর নিয়েই পরীক্ষা দিতে হবে।”

সবাই চুপ। হঠাৎ রাফুলের কণ্ঠ ভেসে এলো, যেন গোপন কোনো স্মৃতি খুলে বলছে-
“মানুষের বিপদ বলে-কয়ে আসে না, হঠাৎ করেই এসে যায়। গত বছর এই দিনে আমারও একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।”

সবাই তাকাল তার দিকে। রাফুল গম্ভীর হয়ে বলল,
-“আমি পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিলাম। সাবান মেখে ডুব দিয়েছি, হঠাৎ দেখি একটা কাক এসে আমার সাবানটা মুখে নিয়ে উড়ে গিয়ে পাশের গাছে বসেছে। আমি সাবানটা ফেরত আনতে ঢিল ছুঁড়লাম। কিন্তু ঢিল কাকের গায়ে লাগল না- গিয়ে লাগল আমার আট বছরের ছোট ভাগ্নের মাথায়।”

সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। রাফুলের কণ্ঠ থরথর করছে।
– “ভাগ্নের মাথা ফেটে গেল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলল মাথার ভেতর আঘাত লেগেছে। কিছুদিন সে সব কিছু ভুলে গেল, এমনকি নিজের নামও চিনত না। কত চিকিৎসা করালাম, এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে বটে, কিন্তু আগের মতো আর হয়নি।”

ঘর ভারী হয়ে উঠল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যেন বুঝতে পারল- একটা ছোট্ট ভুল, একটি অসতর্ক ঢিল- কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

ইমাম সবার ভিড়ে দাঁড়িয়ে রইল, মুখ নিচু করে। বুকের ভেতর আরও ভারী হয়ে উঠল তার অপরাধবোধ। কাকলি জানে না সেই “শয়তানটা” কে ছিল, কিন্তু ইমাম জানে। আর সেই গোপন সত্য তাকে ভেতরে ভেতরে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।

রাফুলের কথাটা শুনে ইমামের বুকটা যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। মনে হলো ধারালো তীরের ফলা বারবার এসে তার হৃদয়ের ভেতরে বিঁধছে। “আমি যে ঘটনাটা আজও কাউকে বলিনি- সেই ঘটনাই হুবহু রাফুল বলছে কেন? ও কি আমার কাণ্ডটা জেনে গেছে? নাকি কাকের পিছু নিতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে, আর সবাই তাই ভেবেই বলে?’’

ইমাম নির্বাক হয়ে গেল। কিন্তু সত্যি কথা হলো- কাকলির উপর এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধের দায়ভার তার কাঁধেই। ঢিলটা যদি কাকলির মাথায় গিয়ে পড়ত, হয়তো আজ তাকে আমরা এই ঘরে বসে দেখতে পেতাম না! ভাবতেই গা শিউরে উঠল। বুকের ভেতর অস্থির এক গ্লানি ঘূর্ণির মতো পাক খেতে লাগল। ইমামের চোখ-মুখ বিষণ্ন হয়ে এলো।

ঠিক তখন রনি বলল,
-“কাককে ঢিলা মারা ঠিক না। কাক সাবান মুখে নিয়ে পালাবে, কিন্তু ঢিল যাবে অন্য কোথাও- আর সেই ঢিলই বিপদ ডেকে আনবে।”

রনি এবার রাফুলের দিকে তাকাল,
-“তোর ভাগ্নে ঘটনাস্থলেই মারা গেলে, তুই কী বিপদে পড়তি ভেবে দেখেছিস?”

ঘরটা নিস্তব্ধ। ইমাম ভেতরে ভেতরে কেঁপছিল। কাকলি হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই ইমু, তুই এত কী ভাবছ? কথা বলছিস না কেন?”

ইমাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কাঁপা গলায় বলল,
-“না, কিছু না… কিছুই ভাবছি না।”

তার কথার আগেই বন্ধু সানু মুচকি হেসে যোগ করল,
-“ও যেন কাকলির অসুস্থতায় অন্য সবার চেয়ে একটু বেশিই চিন্তিত!”

সানুর মুখ থেকে কথাটা বের হতেই চারপাশে হাসি ফেটে পড়ল। ইমাম লজ্জায় মাথা নিচু করে মুখ লুকাতে চাইল। বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল, আর চোখে গরম পানি ভেসে এলো। কাকলিও সানুর কথায় অস্বস্তি পেয়ে চুপ করে গেল।

ইমাম যে কাকলিকে খুব ভালোবাসে- এ সত্যিটা কেবল সানুই কিছুটা আঁচ করে। ইমাম এখনো কাকলিকে কিছু বলেনি। কতদিন ধরে ভেবেছি কীভাবে বলবে, কখন বলবে- সে চিন্তায় ঘুম হারাম হয়েছে। অথচ এই দুর্ঘটনাটা যেন ইমামকে আরও পিছিয়ে দিল। কাকলি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সে কি তাকে বলতে পারবে-
আই লাভ ইউ, কাকলি!”

ঠিক তখন কাকলির খালু ঘরে ঢুকলেন। তার মুখে কঠোরতা, চোখে এক ধরনের প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। সবাই চুপ হয়ে গেল।

খালু হাসিমুখে বলল,
-“বাবারা, তোমরা গল্প কর। তোমাদের জন্য নাস্তা রেডি করছি। না খেয়ে কেউ যাবে না।”

সবাই প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ল। রাফুল বিনয়ের সাথে উত্তর দিল,
-“না খালু, আমরা এতগুলো ছেলে একসাথে হঠাৎ চলে এসেছি। আপনাদের কষ্টের মাঝে এসে আর কষ্ট বাড়াতে চাই না। আমরা এখন উঠি।”

ওরা সবাই ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেল। খালু বারবার অনুরোধ করলেও, শেষ পর্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিয়ে চলে এল। খালুর আতিথেয়তার উষ্ণতা সবাইর বুক ভরিয়ে দিয়েছিল, অথচ ক্ষুধা নয়, কৃতজ্ঞতা নিয়েই সবাই ফিরে আসল।

এদিকে কাকলি তখনও অসুস্থ শরীর নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল। প্রতিদিন পরীক্ষার হলে গিয়ে ইমাম সহপাঠী মেয়েদের বলে দিত যেন কাকলিকে রিকশা থেকে নামিয়ে এনে সিটে বসায়। পরীক্ষা শেষে আবার তাকে রিকশায় তুলতেও ইমাম গোপনে তদারকি করত। কাকলি বুঝতে না পারলেও, হয়তো তার অদৃশ্য যত্নের স্পর্শে কাকলি একটুখানি হলেও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে তার প্রতি।

দিন কেটে যাচ্ছিল দ্রুত। সবার এসএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। অথচ ইমামের বুকের ভেতর জমে থাকা কথা একবারও কাকলিকে বলা হলো না। কতবার ভেবেছে- আজ বলব, আজই জানাবে তার মনের কথা। কিন্তু প্রতিবার তার সামনে দাঁড়িয়ে সাহস হারিয়ে ফেলেছে। একা পেয়েছে বারবার, তবুও ঠোঁটগুলো যেন আটকে গেছে।

ইমাম বুঝেছিলা- যার নিজের ভেতরে সাহস নেই, যে সবসময় ভীরু হয়ে থাকে, সে ভালোবাসায় প্রাণ দেবে কোথা থেকে? যার বুকভরা কষ্টের আলপনাগুলো লুকিয়ে থাকে নিজের অন্দরেই, সে কীভাবে অন্যের কাছে ফুটিয়ে তুলবে নিজের হৃদয়ের নিষ্প্রাণ ও সুপ্ত ভালোবাসার বানী?

ইমাম তেমনই একজন ব্যর্থ প্রেমিক। ভীরু প্রেমিক।
তার ভালোবাসা জন্মেছিল, বেড়ে উঠেছিল, কিন্তু বলার সাহস পেল না। কাকলির দিকে তাকালেই তার মনে হতো- “সে আমারই জন্য, অথচ এক চিলতে সাহসের অভাবে তাকে কাছে টানতে পারিনি। এ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়, আর সেই পরাজয় নিয়েই আমি বাঁচতে শিখেছি।“

সময় গড়িয়ে যায়। ইমাম ইতোমধ্যেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ঢাকায় এক নামী কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। কাকলিও হাতিয়ার বিস্তৃত নদীঘেরা মায়া ছেড়ে এসএসসির পর শহরে পড়াশোনার স্বপ্নে চট্টগ্রাম চলে আসে। হাতিয়ায় যাদের শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত – ইমামের এখন সেখানে ফেরা হয় শুধু দুই ঈদের ছুটিতে। কাকলি এসএসসির পর হাতিয়ায় যাওয়া হয় নি।

কাকলির সাথে ইমামের আর কোনোদিন দেখা হলো না। না কোনো যোগাযোগ, না কোনো চিঠিপত্র। তবুও প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তার অস্পষ্ট ছায়া তার চোখের মণিকোঠায় ভেসে থাকত। একদিন ঈদের ছুটিতে হাতিয়া গিয়ে কাকলির খোঁজ করেছিল। জানতে পারে- এসএসসি পরীক্ষার পর সে খালুর বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে গেছে। তার বাবা বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা; চট্টগ্রামেই তারা নতুন বাড়ি করেছে। তারপর থেকে আর হাতিয়ায় ফেরেনি। যেন এরপর থেকে তাদের মাঝের সব সেতু ভেঙে পড়ল।

ঢাকায় চাকরি নেবার পর থেকে ইমামের বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল। কখনো পরিবারের পক্ষ থেকে, কখনো কনের পরিবারের পক্ষ থেকে। অধিকাংশই হাতিয়ার পরিবার, যারা নদী ভাঙ্গনের জায়গা-জমি হারিয়ে হাতিয়া ছেড়ে বাইরে বসতি গড়েছে। প্রতিবার ইমাম নানান অজুহাতে প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেয়। মনে হতো- কোনো কিছুতেই মন বসছে না, মনে হতো সে এখনও কাকলির কোনো অদৃশ্য ছায়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বার বার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ও তার খুঁতখুঁতে মনোভাব দেখে একসময় সবাই বিরক্ত হয়ে গেল। অনেক দিন আর কেউ আর  জন্য মেয়ে দেখল না।

তার বিয়ে নিয়ে পরিবারের মাতামাতি যখন একেবারে স্তিমিত হয়ে এলো, তখন হঠাৎ একদিন তার বড় দুলাভাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন। ইমাম তখন তাদের ভাড়া বাসায়। সে লক্ষ করল- দুলাভাই তার আম্মার রুমে ঢুকে দরজা এঁটে ফিসফিস করে আলাপ করছেন। সে কদমবুচি করার জন্য দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দুলাভাই হাসিমুখে বের হলেন।

ইমাম সালাম করতেই দুলাভাই তাকে টেনে তুলে চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন-
“এবার যদি খুঁত খোঁজার চেষ্টা করো, তাহলে মনে রেখো- তোমার কপালে আর কোনোদিন বউ জুটবে না!”

কথাগুলো ইমাম বুকের ভেতর ঢেউ তোলে। হঠাৎ ভাবল- “আমার বয়স তো ইতোমধ্যেই ছত্রিশ ছুঁই ছুঁই। আর কত কালক্ষেপণ করব? জীবন তো থেমে থাকে না।“

সে দুলাভাইকে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি আর আপা যাকে পছন্দ করেন, আমার কোনো আপত্তি নেই। আলাপ ফাইনাল করুন।”

তার উত্তর শুনে দুলাভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি খুশিতে ভরে বিকেলেই আবার চট্টগ্রাম ফিরে গেলেন। পরদিন ফোন করে জানালেন- ইমামকে যেন কালই চট্টগ্রাম যেতে হবে।

ইমাম আর দেরি করল না। রাতের ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাত্রির আঁধারে ছুটে চলা গ্রাম আর জনপদ দেখতে দেখতে ভাবছিল- “এটাই কি তবে আমার জীবনের নতুন বাঁক? ভাগ্য কি অবশেষে আমাকে অন্য কোনো রঙে রাঙাতে চাইছে?”

চট্টগ্রাম পৌঁছে জানতে পারল- আজ রাতেই তার বিয়ের আয়োজন! অবাক বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে সে। এত তাড়াহুড়ো করে বিয়েও হয় নাকি? আপা-দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে মুখর চারদিক। চেনা-অচেনা অনেক মুখ, হাসি-ঠাট্টা, প্রস্তুতির ব্যস্ততা- সব মিলিয়ে এক উৎসবের আমেজ।

আর সেই মুহূর্তে যেন ইমাম নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে উৎসব, ভেতরে তার মন ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ভাবতে লাগল- “যার স্বপ্ন একদিন কাকলি নামের এক কিশোরীর চোখে বন্দি ছিল, যার প্রেম কখনো প্রকাশ করতে পারলাম না, সেই আমি আজ জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছি।“

রাতভর সফরে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। তাই ভোরে ঘুমিয়ে পড়ে। চারদিকে কী আয়োজন হচ্ছে, কারা আসছে, কে কী করছে- সবকিছু থেকে সে দূরে থাকল। ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো অচেনা স্বপ্নের ভেতরে ভেসে আছে, যেখানে তার জীবন অন্য কারো হাতে রঙ পেতে চলেছে।

দুপুরে দীর্ঘ ঘুম ভাঙতেই কান ভরে উঠল আত্মীয়-স্বজনদের কলরবে। ড্রইংরুমে খালাদের বিশাল আড্ডা জমে উঠেছে। সে পা টিপে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই এক খালা মজা করে বললেন-
-“এই যে বরমশাই! এত লাজুক কেন? এসো, তোমার গায়ে হলুদ দিতে হবে।”

ইমাম একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মুখের কোণে অপ্রস্তুত হাসি, গালে হালকা লজ্জার আভা, আর চোখে যেন অচেনা অস্বস্তির কুণ্ঠা। দুপুরে গায়ে হলুদের ধুমধাম শেষে হঠাৎ খবর পেল- রাতেই মূল বিয়ের পর্ব সম্পন্ন হবে।

খবরটা শুনে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত আলোড়ন জেগে উঠল। আনন্দ, উৎকণ্ঠা আর দায়িত্বের অদ্ভুত মিশ্রণে মন ভরে গেল। বিকেল নামতেই সে গোপনে একটা রিকশায় চড়ে বেরিয়ে পড়ল। ব্যস্ত নগরীর ভিড় ঠেলে পৌঁছাল কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর কাছে।

নিজ হাতে, বিনীত অথচ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমন্ত্রণ জানাল-
“আজ আমার জীবনের বিশেষ দিন। তোমরা না এলে পূর্ণ হবে না।”

বন্ধুরা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল, তারপর হেসে উঠল। আনন্দে সবার চোখ চকচক করে উঠল। সবাই রাজি হলো, যেন তার সুখের অংশীদার হওয়ার সুযোগ হারাতে চায় না কেউ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আগ্রাবাদ কমিউনিটি সেন্টারের ঝলমলে আলোয় ভরে উঠল চারপাশ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী- সবাই মিলে উৎসবের ভিড়। নিকাহর কলেমার মিষ্টি উচ্চারণে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। সবার দোয়া আর হাসির মাঝে যেন আশীর্বাদের বৃষ্টি নেমে এলো।

তারপর এল ভোজের ধুম। টেবিল ভরে গেল নানা রকম সুস্বাদু খাবারে। হাসি-আড্ডা, খাওয়ার রসনা, মধুর ব্যস্ততা- সব মিলেমিশে সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে গেল এক অদ্ভুত ঝাপসা ঘোরের ভেতর। ইমাম যেন বুঝতেই পারছিল না, সময় কখন তার হাতে থেকে ফসকে যাচ্ছে।

সবশেষে, কোলাহল আর শুভেচ্ছার ভিড় পেরিয়ে নববধূকে নিয়ে ইমাম ফিরল খুলশিতে, তার আপার বাসায়। রাত তখন গভীর হয়ে এসেছে। রাস্তাঘাট নির্জন, অথচ ইমামের হৃদয় ভরে আছে আলোয়- নতুন জীবনের আলো, প্রতিশ্রুতির আলো, ভালোবাসার আলো।

এমন এক রাত, যা শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জীবন ও ভবিষ্যতের এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দিল তার সামনে।

ভাগ্নে-ভাগ্নিরা আগেই সাজিয়ে রেখেছিল বাসরঘর। চারপাশে টাটকা ফুলের মালা, রঙিন লাইটের নরম ঝিলিক, আর বিছানাজুড়ে লাল-সাদা গোলাপের পাপড়ি। সব মিলিয়ে যেন রূপকথার রাজ্যের এক অভিনব দৃশ্য। বাইরে দাঁড়িয়ে সবার মুখে কৌতুকমাখা হাসি, ফিসফিস কথোপকথন- তাদের মজা যেন নতুন বরকে নিয়ে অশেষ। ইমাম শুধু চুপচাপ সেইসব হাসি-ঠাট্টা মেনে নিচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে বুকের ভেতর কাঁপন সামলাতে ব্যস্ত।

অবশেষে দরজা বন্ধ হলো। চারদিকে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।
এক মুহূর্তে ইমামের বুকের ভেতর অদ্ভুত ধুকপুকানি শুরু হলো। এ ঘরটা এখন শুধুই তার আর তার নতুন বউয়ের।

দরজার আড়াল পেরিয়ে ঘরে পা দিতেই মনে হলো, এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে সে। ঘর ভরে আছে ফুলের গন্ধে, রঙিন আলোয় সাজানো পরিবেশ যেন অন্য জগতের। নিজের ঘর হলেও সাজসজ্জার চাকচিক্যে মনে হচ্ছে অপরিচিত কোনো রাজমহল।

ইমাম একটু দ্বিধায় পড়ল। বাতিটা নিভিয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু আবার মনে হলো- প্রথম রাত, প্রথম পরিচয়, আলো থাকাই ভালো। আলোয় যেন সত্যিটা আরও সুন্দরভাবে ধরা দেয়।

চোখ ফেরাতেই সে দেখল- সে বসে আছে শান্তভাবে, নিঃশব্দে। দিনের পরিশ্রমে চোখে জমে আছে ক্লান্তি, মুখে নেই কোনো সাজসজ্জা, নেই আটা-ময়দার প্রলেপ কিংবা কৃত্রিম আভা। অথচ তাকে দেখাচ্ছে অপূর্ব সুন্দর- এক ধরনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য, যেখানে লুকিয়ে আছে শান্তি আর প্রশান্তির গভীর ছাপ।

ইমামের মনে হলো- প্রকৃত সৌন্দর্য কৃত্রিমতার আড়ালে নয়, বরং ঠিক এই সরলতায়।

ইমাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“তুমি কৃত্রিম সাজগোজে নিজেকে আড়াল করোনি, এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ না জানালে অন্যায় হবে।”

তার কথায় নববধূর ঠোঁটে ফুটে উঠল এক মৃদু হাসি। সেই ক্ষণিক হাসি ইমামের অন্তরে ঢেউ তুলল, যেন এক অচেনা সুর তার বুকের ভেতর বাজতে শুরু করেছে।
তবে তার চোখ এড়িয়ে গেল না- গালে হালকা ব্রণ, চোখের নিচে অনিদ্রার কালি, শ্যামলা রঙে মাখা সাধারণ মুখ। কিন্তু ইমামের কাছে সে আজ অপরূপা, কারণ সে নিজের স্বাভাবিকতাকেই বেছে নিয়েছে। সাজসজ্জার আবরণ নয়, বরং প্রকৃত সত্ত্বাকে সামনে আনার সাহসিকতাই তাকে আরও অনন্য করে তুলেছে।

ইমাম আলতো করে তার হাত স্পর্শ করল। স্পর্শে নববধূর ভরসা যেন গলে গিয়ে ইমামের বুকে আশ্রয় নিল। মুহূর্তটি হয়ে উঠল গভীর, নিরাভরণ ভালোবাসার প্রতীক।

কিন্তু হঠাৎ-
তার দৃষ্টি গিয়ে আটকাল এক অচেনা দাগে। শরীরের গোপন এক প্রান্তে পুরোনো সেলাইয়ের চিহ্ন।
ইমামের শরীর যেন মুহূর্তেই শীতল বরফে ঢেকে গেল। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল এক অজানা আতঙ্ক। মনে হলো, হঠাৎ করেই সে প্রবেশ করেছে অচেনা এক অতল খাদে।

তবুও, মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল সে। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা, সমস্ত বাসনা এক গভীর নীরবতায় গিলে ফেলে ফিরে গেল প্রথম আলাপের সহজ কথোপকথনে। যেন রাতের নিস্তব্ধতায়, আলো-অন্ধকারের মিশ্র খেলায়, তারা দুজন ধীরে ধীরে শিখছে- ভালোবাসা কেবল শরীরের নয়, হৃদয়েরও এক অঙ্গীকার।

সে হয়তো ভেবেছে- ইমাম লাজুক, কিংবা এখনও নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারছে না। কিন্তু আসলে তার ভেতরে তখন এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলেছে।
মুখে শান্ত, চোখে নিরীহ হাসি- কিন্তু বুকের ভেতর ঢেউ থেমে নেই।

ইমাম কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না। আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল-
“তুমি লেখাপড়া কোথায় করেছো?”

সে মৃদু হাসল। কণ্ঠে কোনো দ্বিধা নেই, ভরাট ও নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলল-

“আমার এসএসসি হাতিয়ায়, এইচএসসি আর ডিগ্রি করেছি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে। এখন জনতা ব্যাংকে কাজ করছি।”

“এসএসসি হাতিয়ায়—”
শব্দদুটো যেন হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আঘাত করল ইমামের হৃদয়ে।
“হাতিয়া” -এই নামেই বুকের ভেতর অচেনা এক উত্তেজনা গোপনে রক্তে ঢেউ তুলল। অজান্তেই শরীরের পশম খাড়া হয়ে উঠল, নিঃশ্বাসে জমে উঠল এক ধরণের চাপা টান।

এক মুহূর্তেই মনে পড়ল অতীতের সেই ধূসর ছায়া- কাকলি।
শুধু নামের উচ্চারণেই স্মৃতির অন্ধকার কোণ থেকে ভেসে উঠল ঝাপসা চেহারা, অর্ধেক-ভোলা মুখ, এক অদ্ভুত সম্পর্কের অনুরণন।

বিয়ের দিনটিতে তো নববধূর মুখ পুরোপুরি খেয়াল করা হয়নি। পরিচয়ের সূত্রে শুধু শুনেছিল- সে চট্টগ্রামের মেয়ে। আর কানে বাজছিল কেবল একটি নাম- “কাকলি।”
দেশে তো শত শত, হাজারো কাকলি আছে। শুধু নাম মিললেই কি সবকিছু এক হয়ে যায়?

কিন্তু তবুও হৃদয়ের ভেতর এক অজানা আতঙ্ক ধীরে ধীরে শেকড় বিস্তার করতে লাগল।
মনে হচ্ছিল- অতীত ও বর্তমান হয়তো আস্তে আস্তে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে তাকে।

আর এখন সে বলছে সে এসএসসি করেছে হাতিয়ায়- কিন্তু হাতিয়ায় কোথায় পড়েছে, কবে? ইমামের মনে শত প্রশ্ন একসাথে জেগে উঠেছে।
– “তুমি কি ছৈয়দিয়া হাই স্কুলের ’৭৯ ব্যাচের সেই কাকলি?”

সে সূক্ষ্মভাবে বলল- “জি… কেন? কী এমন?”

ইমাম শব্দ খুঁজে পেল না, স্তব্দ হয়ে রইল।

তবে সে ইতিমধ্যেই কথা শুরু করে দিল- মানুষের জীবনের ছোট ছোট পটভূমি খুলে দেয়ার মতো স্বচ্ছ কণ্ঠে: “বাবা নৌ-বাহিনীতে চাকরি করেছেন, তাই আমরা পরে চট্টগ্রামে চলে এসেছি। যে দিন স্টিমারে উঠতে যাব তখন বাতানখালী-তে চাচার বাড়ির সামনে দাদার কবরটা দেখে আমি অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলাম- সেই ছিল হাতিয়ায় আমার শেষ কান্না। তারপর আর কখনও হাতিয়ায় যাইনি।”

ইমাম কড়া চোখে তাকাল- ওর কথাগুলো যেন সবকিছুকে ভাঙিয়ে ফেলল, ভাঙাল আবেগের সব বাঁধ। জিজ্ঞাসা করল- “কেন তুমি এত কেঁদেছিলে?”

কাকলি চুপ করে থাকল- চোখে দূরবৃত্তি, কণ্ঠে অশ্রুতে ভেজা গলাগলি। কিছুক্ষণ পর তখন সে বলল- “দাদার কবরটাকে মেঘনা রাক্ষুসীভবেই খেয়ে ফেলছে। কবরের যে বড় অংশ ছিল, নদী ধীরে ধীরে ভেঙ্গে নিয়ে গেছে; এখন শুধু দাদার দু’টো পায়ের হাড় দেখা যাচ্ছিল। দাদা ছিলেন লম্বা লোক- তাই হাড়গুলোও লম্বা। ওই দৃশ্য দেখেই আমি কেঁদেছি। কী নিষ্ঠুর এই জগত! হাতিয়া দ্বীপের মানুষ- যারা এতিম, যারা বাড়ি–ভিটে হারিয়েছে, তাদের আর্তনাদ যেন প্রতিনিয়ত মেঘনার পারে–পারেই বাজে; কবর পর্যন্ত মেঘনায় উধাও হয়ে যাচ্ছে।’”

তার কণ্ঠে একধরনের বিস্ময় আর অসহায়তাই ভাসছিল- মৃত্যুর স্মৃতি, ভূস্বর্গের অমানবিকতাকে কাঁপিয়ে ওঠা ব্যথা। ইমাম চুপ করে কথা শুনল; মনে হলো, ঐ সব ছবি তার নিজের চোখে ভেসে উঠছে- হালকা বালু, কাঁচা কাদামাটি, গাছের শিকড়ে মোড়ানো নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা কবরগুলো, আর তাদের পাশে স্বজনদের খোলসে বেরিয়ে থাকা হাড়গুলো- সবকিছু যেন তার ধ্যান-জ্ঞান কেড়ে নিচ্ছে।

কাকলি আবার বলল-
-“ওই দিন, আমি কাঁদছিলাম। শুধু আমারই কান্না নয়- হাতিয়ার হাজার হাজার মানুষের কান্না ছিল। তাদের দুঃখ যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, প্রতিনিয়ত আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দেয়।”

তার দাগ-কাটা কথাগুলো ইমামের হৃদয়কে বড় অচেনা ভাবে নাড়িয়ে তুলল। সে হঠাৎ বুঝল- “আমার কিশোর বয়সে যে নিঃসঙ্গ প্রেমটি হঠাৎ করে ম্লান হয়ে গিয়েছিল, তার পেছনে ছিল এমন এক কুঠুরি ইতিহাস- একখানা টিকে থাকা স্মৃতি, নদীর হাবভাব আর মানুষের হারানোর বিপর্যয়। কাকলি তখন অপ্রাপ্ত বয়সের মেয়ে তবুও তার ভেতরে অতীত এখনো পুরোটাই হারিয়ে যায়নি।

সে তখন চেয়ারে বসল, চোখের কোণে আর্দ্রতার ফোঁটা জমে আছে। টেবিল থেকে তুলে নিল এক গ্লাস দুধ। ইমাম কাকলির কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। তার কণ্ঠে একইসাথে একটা চাপা অস্বস্তি এবং এক ধরনের অস্বাভাবিক ভালোবাসা ফুটে উঠল। সে নীরবে তার দিকে তাকালো; তার চোখে এমন এক সহানুভূতি আর অকারণ মমতা ছিল, যা সচরাচর দেখা যায় না।

ইমাম কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না , শুধু মনে হলো- এই মানুষের অতীত, তার ভাঙা স্মৃতি আর নদীর ভাঙন- সবই এখনো তাকে ঘিরে আছে। বুঝলাম, আমার জীবনেরও এক অংশে এখনো হাতিয়ার আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাকলির কথা যেন আবার মনে করিয়ে দিল- নদী শুধু জমি বা স্থায়ী ঠিকানা কেড়ে নেয় না, কেড়ে নেয় ইতিহাস, নাম, স্মৃতি, আর শেষে মানুষের হাড়গোড়ও কেড়ে নেয়।

ওরা দু’জনে কিছুক্ষণ চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরে রাতের মানুষের কোলাহল, রাস্তার গাড়ির শব্দ, আর ওদের ভেতরের শান্ত কথোপকথন- সবই যেন এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি করছিল। ইমাম ভাবল, আজকের এই রাত, তার নতুন জীবন, আর অতীতের সেই কিশোরীর সাথে তার কথা- সবকিছু মিলে যেন একটা অদৃশ্য সাঁকো তৈরি হচ্ছে।

বাসর ঘরের মৃদু আলোতেও কাকলির চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন পুরো কক্ষটিকে এক বিষণ্ণ আবেশে সিক্ত করে তুলছিল। ইমাম লক্ষ্য করল, ক্ষণিকের মধ্যে ফুলের পাপড়িগুলোও যেন তাদের সজীবতা হারিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে নিস্তব্ধে ঝিমিয়ে পড়েছে। এমন এক নিবিড় মুহূর্তে তার মনে হলো, মেঘনার মতো কঠিন বাস্তবতার কথা তুলে এনে কাকলিকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। তাই সে নিজেকে সামলে নিয়ে কথোপকথনটি ব্যক্তিগত স্মৃতির দিকে ঘুরিয়ে দিল।

ভেতরের চাপা উত্তেজনা সামলে নিয়ে ইমাম বলল, “তুমি তো তোমার খালুর বাড়িতে থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে এসএসসি শেষ করেছিলে, তাই না?”

কাকলি হঠাৎ তার দিকে তাকাল, চোখে বিস্ময় আর কিছুটা অবাক ভাব- “তুমি এসব কীভাবে জানলে?”

ইমাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল, কোনো উত্তর দিল না। মনে মনে ভাবছিল, কীভাবে এমন ছোটখাটো ঘটনা কেউ মনে রাখতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “টেস্ট পরীক্ষার দু’দিন আগে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে যখন তুমি সাবান মেখে গোসল করছিলে, তখন এক দুর্বৃত্ত ইট ছুঁড়ে তোমার নিতম্বে আঘাত করেছিল। তিনটি সেলাই লেগেছিল।”

কাকলি হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চোখে এক চিলতে অবাক ভাব, যেন সে কোনো ফকির বা আধ্যাত্মিক জগতের লোকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! মুখে মৃদু বিস্ময় নিয়ে একদৃষ্টে ইমামের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আরে! তুমি এসব কীভাবে জানলে, কে বলেছে তোমাকে?”

ইমাম তার দিকে ধীরে ধীরে তাকাল। মনে হলো, চোখে চোখ রাখলেই যেন সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। ভেতরের সব লুকানো অনুভূতি, দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা ভালোবাসা- সব যেন খুলে বেরিয়ে আসছে। কণ্ঠে হালকা কাঁপুনি, কিন্তু স্থিরভাবে বলল, “তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, চিনতে পারছো কিনা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম। সাহস ছিল না, তাই কখনও বলতে পারিনি।”

কাকলির চোখে যেন আলোর ঝিলিক খেলে গেল, মনে হলো কিছুটা অবাক, কিছুটা লজ্জা মেশানো হাসি। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, “মুখভর্তি দাড়ি থাকলে কি চেনা যায়! তখন নিশ্চয় গোঁফ-দাড়ি ছিল না। তুমি আগে নিজের পরিচয় দাও।”

ইমাম একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “রাগ করবে না তো?”

কাকলির মুখে সামান্য খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। সে বলল, “রাগ করার তো আমি কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।”

ইমাম আরও সাহস সঞ্চয় করে বলল, “শোনো তাহলে। সেই দিন পুকুরঘাটে তোমার নিতম্বে ইট ছুঁড়েছিলাম আমিই। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না, অনিচ্ছাকৃতভাবে তোমার গায়ে পড়েছিল।”

কাকলির চোখে বিস্ময় ও অবিশ্বাসের মিশ্রণ ফুটে উঠল। সে প্রশ্ন করল, “তাহলে সেই দুষ্ট ছেলেটা তুমিই? কেন সেদিন ঢিল ছুঁড়েছিলে? সেই সময় আমি শরীরের উপরের জামাকাপড় খুলে সাবান মাখছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে এমন দৃশ্য দেখে সইতে না পেরে ঢিল ছুঁড়েছো, বুঝি- ছি:!”

ইমাম কাঁপা কণ্ঠে বলল, “একদম ঠিক না। আমি তোমাকে দেখতেই পাইনি। সাবানচোর কাককে ঢিল ছুঁড়েছিলাম, তা গিয়ে পড়েছে তোমার গায়ে। তোমার চিৎকার শুনে আমি বুঝতে পেরেছি ঘাটে কেউ একজন ছিল, দেখার আগেই দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

কাকলির চোখে বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, “সাবানচোর কাককে ঢিল ছুঁড়েছি মানে?”

ইমাম বিষয়টি পুরোটা খুলে বলল, “শোনো, সেদিন দুপুরে আমি বাংলা ও কসকো সাবান নিয়ে আমাদের দরজার বড় পুকুরঘাটে গোসল করতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দুটো কাক ছোঁ মেরে আমার সাবান দুটো নিয়ে যায়। আমি ঢিল নিয়ে ওদের পিছু নিই। তারপর—”

কাকলির মুখে হঠাৎই হালকা হাসি ফুটল। সে বলল, “তাই! এতকিছু হয়ে গেল সেদিন। সামান্য কাক পাখি, অথচ ওদের কারণে তোমাকে ধানক্ষেতে পালিয়ে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল। আমিও রক্তাক্ত হয়েছিলাম। তাহলে তুমি সেই ইমাম হোসেন ইমু, ক্লাস ভর্তি এতগুলো ছেলে-মেয়ের সামনে অপলক দৃষ্টিতে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে, তাই না?”

ইমাম মাথা ঝুঁকিয়ে, লজ্জা ও ভালোবাসার মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমিই সেই ইমু। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম। লজ্জায় মুখ ফুটে কখনও বলতে পারিনি। আমার এত বছরের স্বপ্ন আজ যেন পূর্ণতা পেয়েছে। দুলাভাই আমার কাঙ্ক্ষিত মনের সেই আঁচলেই আমাকে বেঁধে দিয়েছেন সবার অজান্তে। তাই উনার প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ।”

কাকলির চোখে অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বলতা, বিস্ময় ও শান্তি- সব মিলেমিশে ফুটে উঠল। সেই দীর্ঘদিনের লুকানো ভালোবাসা আজ প্রকাশ পেতে চলেছে। মুহূর্তগুলো যেন স্থির হয়ে গেল, আর তাদের চারপাশের পুরো রুমটিই যেন এই আবেগের সাক্ষী হয়ে রইল। ওরা দু’জনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে থাকে, অতীতের সব দ্বিধা, লজ্জা ও স্বপ্ন মিলিয়ে আজ নতুন অধ্যায়ের শুরুতে প্রবেশ করছে।

ওদের কথোপকথন ধীরে ধীরে গভীর হয়ে এলো, কাকলির চোখে মিশ্র অনুভূতি- আশ্চর্য, বিনয়, আর আনন্দ ফুটে উঠল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ছেলেদের চোখের দৃষ্টিবিন্যাস, হাবভাব, আঙুলের নড়াচড়া- মেয়েরা সহজেই সব বুঝে যায়। তুমি যে আমার প্রতি দুর্বল ছিলে, আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। একটা মেয়ে বুঝে থাকলেও না বোঝার ভান করে, অপেক্ষা করে কখন ছেলেটা নিজ থেকে বলবে- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ আর ছেলেটা যদি সেটা বলতে না পারে, তাহলে ভালোবাসার মৃত্যু ঘটে।”

কাকলির চোখে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা কৌতূহল, আর কিছুটা হাসির ঝিলিক ফুটল। সে আরও বলল, “মেয়েটা ‘না’ বলতে পারে- এই ভয়ে বেশিরভাগ ছেলে প্রপোজ করতে সাহস পায় না। সময় চলে যায়, মেয়েটার হয়তো অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। ভালোবাসি বলা একটি ছেলের জন্যও অত্যন্ত জটিল। কারণ আমরা মেয়েরা মান হারানোর ভয়কে সবচেয়ে বড় বিপদ মনে করি। তখনও তুমি আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলতে পারোনি।”

ইমাম তার দিকে তাকিয়ে বলল- “আসলে আমি খুবই লাজুক ও ভিতু স্বভাবের ছিলাম।

কাকলি বলল- “আমাদের এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হতো না। তুমি যদি সেই সময়ে লজ্জা ছেড়ে মুখ ফুটিয়ে বলতে পারতে, তাহলে হয়তো আমাদের বিয়ে সঠিক সময়ে সম্পন্ন হত।”

কাকলির চোখে স্নিগ্ধতা, লাজ, আর আনন্দের মিশ্রণ ফুটে উঠল। ইমাম ধীরে জিজ্ঞেস করল-

“তুমি কি তখনও আমার প্রেমে সাড়া দিত?”

কাকলির চোখে দীপ্তি বাড়ল, লজ্জা মিশ্রিত হাসি নিয়ে সে বলল-

“মেয়েরা আগ বাড়িয়ে সাড়া দেয় না। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত, যেহেতু তোমার পাজরের হাঁড় দিয়ে আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই হয়তো তখনও সাড়া দিতাম।”

ইমাম হালকা কণ্ঠে, কাকলির দিকে তাকিয়ে বলল-

“তুমি এতদিন বিয়ে করনি কেন?”

কাকলির চোখে সান্ত্বনা, হৃদয়ের উষ্ণতা আর দীর্ঘদিন লুকানো ভালবাসার প্রতিফলন- সব মিলিয়ে যেন ঘরের বাতাসকে উজ্জ্বল করে তুলল। এই মুহূর্তে বোঝা গেল, দীর্ঘ অপেক্ষা, লাজ, দ্বিধা- সব মিলিয়ে তাদের ভালোবাসা আজ চূড়ান্ত রূপ পেতে শুরু করেছে।

কাকলির চোখে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। সে যেন অতীতের স্মৃতি থেকে ফিরে এসেছে। কাকলি ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে বলল- “সৃষ্টিকর্তা হয়তো তোমার অপেক্ষায় আমাকে বিয়ের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করার পর আব্বু আমার জন্য পাত্র খুঁজছিল। সেই সময় হঠাৎ আব্বু হৃৎ রোগে মারা গেল। উনার মৃত্যুর দুই বছর পর আমার জনতা ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার পদে চাকরী হয়। আমার ছোট আরো দুই ভাই ও দুই বোন। এতবড় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়ে হয়ে আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। ভাই-বোনদের পড়ালেখা, অসম্পূর্ণ বাড়ির নির্মাণ কাজ- সব শেষ করতে এতগুলো বছর কেটে গেছে। তাই বিয়ের কথা কখনো ভাবতে পারিনি।”

ইমাম নিঃশ্বাস থামিয়ে বসে আছে। কাকলির চোখে মিশ্র অনুভূতি- দুঃখ, দায়িত্ববোধ, এবং আত্মত্যাগের প্রশান্তি।

ইমাম বলল- “আমি তোমাকে আমার প্রেমের প্রস্তাব দেব ভাবছিলাম। কিন্তু সেই সময়, কাকের মুখ থেকে সাবান উদ্ধার করতে গিয়ে তুমি রক্তাক্ত হয়ে গেলে, প্রস্তাব দেওয়ার সাহস পাইনি। এসএসসি পরীক্ষার পরদিন তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে, তারপর থেকে তোমার সন্ধান পাইনি। মনে হচ্ছে দুষ্ট কাক শুধু সাবান চুরি করেনি, সে চুরি করেছে আমার ভালোবাসার মানুষটিকেও।”

কাকলি হালকা হেসে বলে- তখন তো আমাদের বয়স হয় নি।

ইমাম দৃঢ় কন্ঠে বলল- বয়স হয় নি তাতে কী? প্রেম তো বছরের পর বছর ধরেও বেঁচে থাকতে পারে।

রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। জানালার বাইরে পাহাড়ের ঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ একবার কাকের ডাক ভেসে আসে। ঘরের ভেতর আলো-আঁধারি। ঠিক তখনই কাকলি হেসে ইমামকে প্রশ্ন করল-

“শোনো, কাকেরা সাবান চুরি করে কেন, তুমি জানো?”

ইমাম চমকে তাকাল। প্রশ্নটা হালকা, অথচ ভেতরে যেন লুকিয়ে আছে কোনো রহস্য।
“না,” সে ধীরস্বরে বলল, “আমি ভাবতাম ওরা শুধু খাবার চুরি করে। কিন্তু সেদিন বুঝলাম, কাক কেবল নিজের আনন্দের জন্যও চুরি করতে পারে। আর সেই চুরি কখনো কখনো মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনে। অনেকটা ভাগ্যের মতো- অপ্রত্যাশিত, অদৃশ্য। যেমনটা ঘটেছিল সেইদিন আমার ও তোমার বেলায়।”

কাকলির চোখে ভেসে উঠল ঝলমলে এক রহস্যময় আলো। সে মৃদু হেসে বলল-
“হ্যাঁ, প্রতিটি ঘটনার ভেতরেই কোনো না কোনো শিক্ষা লুকানো থাকে। কেবল হৃদয় খুলে সেই শিক্ষা খুঁজে নিতে হয়।”

ঘরের বাতাস তখন ভারী। নীরবতার ভেতরে বাজতে থাকে অদৃশ্য সুর- স্মৃতির, লজ্জার, আকাঙ্ক্ষার আর দীর্ঘ প্রতীক্ষার। তাদের অতীত আর বর্তমান এক অদ্ভুত স্রোতে মিশে গেল।

ইমাম হঠাৎ গভীর স্বরে বলল-
“মনে হয়, কাকেরা টিভির বিজ্ঞাপন দেখে ভেবেছিল, সাবান মাখলেই কালো থেকে ফর্সা হবে। যেন তাদের কালো ডানায় আলো ফুটে উঠবে। কিন্তু পরে বুঝল, এ সবই বিজ্ঞাপনের ভেলকি। যতই সাবান মাখুক, কাক কাকই থাকবে- কালো চোখ, কালো ডানা। সাদা হওয়ার গল্প শুধু প্রতারণা। তাই সাবানচুরি বন্ধ করেছে তারা। তবে যদি আবার ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে, কে জানে- আবার নতুন প্রলোভনে পড়ে কিনা!”

কাকলি হালকা হাসল। সেই হাসিতে ছিল ব্যঙ্গ, ছিল সত্যের দীপ্তি।
“ফেয়ার এন্ড লাভলী?” সে বলল, “ওটা তো কেউ পুকুরঘাটে ফেলে রাখে না, সাজঘরে ড্রেসিং টেবিলে থাকে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সাবানের মতো এটাও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। কালোকে সাদা করতে পারে না, পারে শুধু ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। এতে ক্যান্সারের ঝুঁকি পর্যন্ত আছে। মানুষের জন্যই এটা ভয়াবহ, কাকের জন্য তো আরও মারাত্মক।”

ঘর আবার নীরব হয়ে গেল। শুধু বাইরে কাকের ডাক ভেসে আসছিল, যেন তারাও স্বীকার করছে-
ভুল ভরসার পেছনে ছুটে কখনো মুক্তি মেলে না।

কাকের সাবানচুরি তাই শুধু একটি কৌতুক নয়- এ এক আয়না, যেখানে মানুষ নিজের ভ্রান্ত বিশ্বাস আর অন্ধ প্রলোভনকেই দেখতে পায়।

কাকলির চোখে কৌতূহল দেখা দিল।

ইমাম আবার বলতে লাগল-
“দেখো, অনেক মানুষ এখনো সুন্দর হওয়ার আশায় এসব সাবান বা ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহার করে। কিন্তু সত্যিটা হলো, এগুলো কারো চামড়ার রং পরিবর্তন করে না। জন্মের সময় যে রঙ নিয়ে মানুষ আসে, সেটাই তার আসল পরিচয়। সাবান কেবল ময়লা দূর করে, এর বেশি কিছু নয়। কাকরা হয়তো আগেই বুঝে গেছে বিজ্ঞাপনের ভেলকি। তাই আজকাল আর সাবান চুরি করে না।”

কাকলির চোখে কৌতূহল জমল। সে চুপচাপ শুনছিল। ইমাম আরও বলল-
“তবে কখনো যদি কাককে চুরি করতে দেখা যায়, সেটা খুবই বিরল। আগেকার সাবানে পশুর চর্বি ব্যবহার করা হতো- সে কারণেই কাক আকৃষ্ট হতো। এখন প্রযুক্তির উন্নতিতে সেই জায়গায় কেমিক্যাল এসেছে। ফলে কাকের আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। আর তুমি হয়তো খেয়াল করছ না, কারণ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে তুমি ব্যস্ততায় ডুবে গেছ। সেই অবসরের দিনগুলো আর নেই, যখন কাকের ছোট্ট চুরি দেখার মতো সময় ছিল।”

কাকলি হেসে বলল-
“ওহ! তাহলে বুঝছি তোমার দিনগুলো কেটেছে কাকের পেছনে ছুটে?”

ইমাম মাথা নুইয়ে হেসে উত্তর দিল-
“হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়। কিন্তু ভাবো তো, সেই ছোট্ট কাকের ঘটনাতেই আমাদের জীবনের বড়ো শিক্ষা লুকিয়ে আছে- মানুষের তাড়াহুড়া, বিজ্ঞাপনের মিথ্যা প্রলোভন, আর প্রকৃত সৌন্দর্যের মূল্য।”

ঘরে তখন নিস্তব্ধতা। সেই নীরবতা যেন তাদের ভেতরের ভাবনাগুলোকে হৃদয়ের গভীরে জমিয়ে রাখছিল। কাকের ছোট্ট চুরি থেকে শুরু হয়ে মানুষের বড়ো ভুল- সব মিলিয়ে তাদের মনে জন্ম নিচ্ছিল এক মধুর উপলব্ধি।

হঠাৎ দূরে কোথাও একঝাঁক কাক ডাকল। শব্দটা যেন নিছক কাকের ডাক নয়- বরং অতীতের সব স্মৃতি, সব প্রলোভন আর সব সত্যকে মনে করিয়ে দিল। এক মুহূর্তে ইমামের মন ডুবে গেল অব্যক্ত চিন্তায়।

ঠিক তখনই আযানের সুমধুর সুর ভেসে এলো-
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।”

শব্দটি যেন তাদের সমস্ত চিন্তাকে ছাপিয়ে দিল। কাকের কোলাহল, বিজ্ঞাপনের ভেলকি, জীবনের শিক্ষা- সব পেছনে পড়ে গেল। শরীর ও মন একযোগে সেই আহ্বানে সাড়া দিল। তারা দু’জনই নীরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল নামাজের জন্য।

ঠিক তখনই আযানের সুমধুর সুর ভেসে এলো-
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।”

শব্দটি যেন তাদের সমস্ত চিন্তাকে ছাপিয়ে দিল। কাকের কোলাহল, বিজ্ঞাপনের ভেলকি, জীবনের শিক্ষা- সব পেছনে পড়ে গেল। শরীর ও মন একযোগে সেই আহ্বানে সাড়া দিল। তারা দু’জনই নীরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল নামাজের জন্য।

রাতটা যেন বাসর ঘরের আবেশেও কাকের স্মৃতির ছায়া নিয়ে বয়ে চলেছে। প্রতীক্ষার দীর্ঘ রাত্রি, আগের দিনের কাকের গল্প, অদৃশ্য আবেগ- সব মিলেমিশে ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত মায়ার তরঙ্গ তুলছে।

কাকলি ইমামের বুকের ওপর মাথা রেখে নিশ্চুপ শুয়ে আছে। ডিম আলোর মোলায়েম আভা তার মুখে এক অদৃশ্য দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছে। সহপাঠিনী হলেও বয়সে হয়তো দু’বছরের ছোট সে, কিন্তু তার মানসিকতার পরিণত সৌন্দর্য ইমামকে নিঃশব্দে মোহিত করে চলেছে।

ইমাম ধীরে ধীরে কাকলির এলোমেলো চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিল, তারপর পরম মমতায় তার কপালে রাখল এক মোলায়েম চুম্বন। সেই ক্ষণেই তার মনে হলো- প্রিয় মানুষটিকে এভাবে বুকে আগলে রাখার ভেতরেই লুকিয়ে আছে জীবনের সমস্ত সুখ, প্রশান্তি আর নিবিড় শান্তির পূর্ণতা। বাসর ঘরের নাটকের পর্দা যেন নিজে থেকেই নেমে এলো- চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারকে ঢেকে দিল নরম আলোয়, আর নিস্তব্ধতাকে রূপ দিল এক সুরেলা শান্তিতে।

তবুও জীবন কেবল আবেগে ভেসে থাকা নয়, দায়িত্বের ডাক অগ্রাহ্য করা যায় না। তাই কাকলিকে কোমলভাবে বাহুডোরে জড়িয়ে রেখে ইমাম নিঃশব্দে খাট থেকে নামল, অত্যন্ত সাবধানে দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। মসজিদের মিনার তখন আকাশে দাঁড়িয়ে আছে চিরন্তন প্রহরীর মতো, ভোরের আগমনী বার্তা নিয়ে। সে রওনা হলো ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে।

নামাজের মধুর আলোয় তার শরীর ও মন ক্রমে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে উঠল। কাকের ডাকের পুরনো স্মৃতি, দিনের ক্লান্তি, আর বাসর ঘরের উচ্ছ্বাস- সব মিলেমিশে যেন এক অদ্ভুত স্মৃতির জাল বুনে চলল মনে। রাত তখনও শেষ হয়নি, অথচ তার ভেতরেই যেন নতুন এক ভোরের শুভ সূচনা হচ্ছে।

ইমামের মনে তখন কেবল একটিই উপলব্ধি- জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, যদি ভালোবাসা আর দায়িত্ব একসাথে হাতে হাত রেখে চলে, তবে সেখানেই লুকিয়ে আছে সত্যিকার শান্তি, সত্যিকারের আনন্দ এবং পরিপূর্ণ জীবনের সার্থকতা।

সমাপ্ত

 

 

 

 

সর্বাধিক পঠিত

কোম্পানীগঞ্জে পুকুরে ডুবে দুই ভাইয়ের মৃত্যু

গল্প : ‘কালো ডানায় বাসররাত’

আপডেট: ০৮:৩৭:১২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

(দুটি কাক, দুটো সাবান আর এক কিশোরের হাতে ইটের ঢিলা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। গল্পটা শুরু হয় হালকা কৌতুকে, কিন্তু হঠাৎ করেই জীবন ছুঁয়ে ফেলে এক ভয়াবহ সত্য ঘটনা। কাকের সাবান চুরি যেন হয়ে ওঠে এক নির্মম নিয়তির ফাঁদ। অজান্তেই ছুঁড়ে দেয়া এক টুকরো ইট ভেঙে দেয় এক ষোড়শীর শরীরের শান্তি।
আর ইমামের চোখের সামনে খুলে যায় রক্তমাখা বাস্তবের দুয়ার। এই গল্পে আছে হাসি, আছে হাহাকার, আছে কৈশোরের নির্দোষ দৌড় আর অপ্রত্যাশিত পরিণতির শিহরণ। “কালো ডানায় বাসররাত” শুধু কাকের গল্প নয়- এ এক অদৃশ্য ছায়া, যে ছায়া আমাদের জীবনের অপ্রত্যাশিত রাতগুলোতেও ডানা মেলে।)

এম দিলদার উদ্দিন

কাকের ডাক কানে এলে কারই বা ভালো লাগে!
সারাক্ষণ কানের কাছে কা-কা শব্দে আকাশ মাথায় তুললে মন অকারণে তিরিক্ষি হয়ে ওঠে। হয়তো এজন্যই বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- কাকস্য পরিবেদনা অর্থাৎ কাকের আর্তনাদ।

কালো রঙের এই পাখির গলা অদ্ভুত ধূসর আভায় মিশে থাকে। তার চোখ দুটো ছোট অথচ তীক্ষ্ণ, ঠোঁট ধারালো, পা শক্ত। দল বেঁধে চলাই তাদের স্বভাব। শত্রুর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে কাকের জুড়ি মেলা ভার। একটা কাক আহত হলে কিংবা মারা গেলে পুরো পাড়া কেঁপে ওঠে- ডানায় ঝড় তোলে তারা, শোক আর প্রতিবাদ মিলেমিশে কালো মেঘের মতো নেমে আসে আকাশজুড়ে।

কাক নিয়ে যেমন লোকমুখে তাদের বুদ্ধিমত্তার গল্প ছড়িয়ে আছে, তেমনি বোকার পরিচিতিও কম নয়। বলা হয়, কাক যখন খাবার চুরি করে লুকোয়, তখন নিজের চোখ বন্ধ করে ভাবে কেউ দেখেনি। অথচ পরে সেই লুকোনো জিনিস নিজেই খুঁজে পায় না।
কাকের এই ধুরন্ধর অথচ বোকামিপূর্ণ স্বভাব এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব তৈরি করে- স্মার্ট না বোকা, কোন দিকেই বা তার আসল পরিচয়?

তবুও মানুষ কাককে ভাল চোখে দেখে না।
কারণ এর কীর্তি কম নয়-
রোদে শুকানো মাছ বা মশল্লা হোক, খাবার বা সাবান হোক, হাস-মুরগির ছানা হোক- সবই ওরা সুযোগ পেলে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। গৃহস্থের শান্তি নষ্ট করা যেন ওদের জন্মগত দায়িত্ব। এরা কখনও সঙ্গী হয় না, বরং বিপদে ঠেলে দেয় মানুষকে।

হয়তো এজন্যই বহুজন মনে করে, কাকের ডাক অশনি সংকেত বয়ে আনে। আর সত্যিই, কাকের সেই ডাকই একদিন চরম বিপদের বার্তা হয়ে নেমে এসেছিল ইমাম হোসেন ইমুর ছাত্রজীবনে।

ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে পুকুরে গোসল ছিল ইমাম হোসেনের নিত্য দিনের রুটিন। দশম শ্রেণির ছাত্র সে- চোখেমুখে নিষ্পাপ সরলতা, আবার দুষ্টামির ছাপও কম নয়।
পুকুর ঘাটের জন্য বাঁশের খুঁটির উপর আট ইঞ্চি চওড়া আর দশ–বারো ফুট লম্বা দুইটি তক্তা জোড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এক ধরনের মাচা। গোড়ায় গেঁড়ে রাখা কাঠির উপর ঝোলানো থাকত গামছা কিংবা শুকনো কাপড়।

সেদিন দুপুরেও যথারীতি ইমাম পুকুরে নামে। ঘাটে রাখা সাবানদানীতে একটি বাংলা সাবান আর একটি চকচকে কসকো সাবান রেখে বুকসমান পানিতে সাঁতার কেটে কয়েকবার ডুব দিয়ে ফেরে ঘাটে। কিন্তু এসে দেখে- সাবানদানী ঠিক জায়গায় আছে, অথচ সাবান দুটি নেই!

চোখ কচলে অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল সে। কেউ নেই। হঠাৎ দূরে করই গাছের মগডালে চোখ আটকে গেল- দুটি কাক ঠোঁট দিয়ে সাবানগুলোকে ঠুকরে খাচ্ছে। দুই পায়ে শক্ত করে চেপে ধরে সাবান গিলছে যেন মন ভরে রসনা তৃপ্ত করছে।

ইমামের মাথায় রক্ত উঠে গেল। “ওরে কাকচোর!” -মনে মনে বলল। তারপর পুকুর থেকে উঠে কয়েকটি ইটের টুকরা হাতে তুলে কাকের দিকে ছুঁড়ল। কাক দুটি সাবান মুখে নিয়ে উড়ে গেল পাশের আরেকটি বাড়ির পুকুরপাড়ে। ইমাম এবার দৌড় শুরু করল- “আজ আর সাবান ছাড়ব না, মা-বাবার বকুনি থেকে রক্ষা পেতে হলে সাবান নিয়েই ঘরে ফিরতে হবে।‘’

হাঁপাতে হাঁপাতে ইমাম এসে যা দেখল, তাতে তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়!
বড় এক গাছের ডালে বসে এক কাক আরামে কসকো সাবান চিবুচ্ছে। ঠিক তার পাশেই আরেক কাক বাংলা সাবান নিয়ে ব্যস্ত। যেন দু’জন দম্পতি একসাথে খাওয়াদাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

কাকদুটো শুধু সাবান খাচ্ছেই না, নাটকও করছে।
একবার ঠোকর দিল, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বামে তাকাল। আবার ঠোকর, এবার ডানে তাকাল। তারপর নিচে ঝুঁকে মুখে কী যেন বিড়বিড় করছে।

ইমামের মনে হলো, ওরা যেন বলছে-
খাবি… খা… খাবি… খা

মানে, “আমরা তো খাচ্ছি, তুইও আয় ভাই, সাবানের ভোজ শুরু হয়ে গেছে!”

এ দৃশ্য দেখে ইমামের মাথা একেবারে গরম হয়ে গেল।
সে গালি ছুঁড়ে বলল-
“এই শালার কাকচোরা! আমার সাবান চুরি করে খাচ্ছিস, আবার আমাকে দাওয়াতও দিচ্ছিস? হালারপুত, তোরে তো আজ ছাড়ছি না!” বলেই সে একটা ইট তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারল।

সাবান দুটির একটি কাকের মুখ থেকে ছিটকে পুকুরের পাড়ে গিয়ে পড়ল। অপর সাবানটিসহ কাকগুলো উড়ে চলে গেল, কিন্তু ঘটনাটা এখানেই শেষ হলো না।

কারণ- যেখানে ঢিল পড়েছে, সেখানে ঘটছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। পুকুরের ঘাটে তখন গোসল করছিল এক ষোড়শী। তার শরীরে তখন সাবান মাখাচ্ছিল ভেজা আধভেজা ঢঙে। অথচ ইমামের মন তখন কেবল কাকের সাবান গেলা, সাবান উদ্ধার জন্য তার লড়াই আর সাবান না নিয়ে ঘরে ফেরার অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্ভাবনায় আটকে আছে। ফলে মেয়েটির নগ্ন দেহ, দুলতে থাকা চুল, এবং দেখার আখাংকা- সবকিছু তার নজর এড়িয়ে গেল।

এটা হয়তো তার জন্য বিপদের এক অদৃশ্য প্রাকৃতিক মঞ্চ। ইমাম বুঝতে পারল না, কাকের সাবান চুরি- আজ তাকে এমন এক মুহূর্তে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। অথচ তার চোখ পড়ে ছিল কেবল কাকের দিকে।

কাককে ছোঁড়া ঢিলটি গিয়ে পড়ল সরাসরি মেয়েটির পিঠের নিচে- নরম মাংসে। ধারালো ইটের আঘাতে তীব্র ব্যথায় মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল।

ইমাম যেন একেবারে থ হয়ে গেল। চোখের সামনে পুরো দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে পারছিল না সে।
সাবান হারানোর দুঃখে সে যতটা না শক পেয়েছিল, তার চেয়ে শতগুণ বেশি শকে ডুবে গেল এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখে। মনে হলো- কাকের সাবান চুরি শুধু নয়, আজ তাকে এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের মুখে ঠেলে দিল, যার ব্যাখ্যা দেয়া তো দূরের কথা- নিজেকেই সামলাতে পারছে না।

মেয়েটির চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে গেল। কে ঢিল ছুঁড়েছে তাকে ধরার জন্য পুকুর পাড়ের  দিকে দৌড়ে এলো বাড়ির লোকজন, ইমাম ভয়ে অচেতন- ধরা পড়ার ভয়ে শরীরটা কাঁপতে লাগল। অর্ধ কিলোমিটার দৌড়ে সে রাজাশাইল ধানক্ষেতে ঢুকে পড়ল। আটপৌরে গরম, ফসল গোড়ায় কাই কচড়ে মাটি। সে দৌড়ে গিয়ে ধানগাছের একটা ফাঁকা জায়গায় শুয়ে পড়ল। মাটির কাদা মেখে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।

কানে তখনও ভিড়ের হৈচৈ ভেসে আসছে- দৌড়ে আসা মানুষের গলা। কেউ ব্যস্ত গলায়- বেয়াদপটা পালাল কোথায় ?

কারো কারো গরম গলায়-
“ধর ধর শালারে ধর!”
“তুই এদিকে যা, আমি ওদিকে দেখছি!”

শব্দগুলো কাছাকাছি এলো, ইমামের কানে তা যেন ক্রমে বড় হয়ে তার কানের পর্দায় বেজে উঠেছে- মনে হচ্ছে ওরা তার কাছাকাছি চলে এসেছে। এ বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছে।

ইমাম মিয়া বাড়ির ছেলে। যারা তাদের পরিবারের মুরুব্বীদের সব সময় সন্মান দিয়ে চলে আসছে এবং তাদের কাছ থেকে জমি কিনে মেঘনার ভাঙ্গন কবলিত এলাকা হাতিয়ার উত্তরাংশ থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছে- আজ তাকে হয়তো ওদের হাতেই মার খেতে হবে। সে ধান খেতের ভিতর একদম স্থির হয়ে শুয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ তার মনে এক ভাবনা বেজে এলো- ‘’আমি না বুঝে কত বড় অপরাধটা করে ফেললাম?’’ মাঠের ভেতর থেকে ইমাম শুনে- কেউ একজন বলছে, “এত বড় বিশাল ধান ক্ষেত, শয়তানটাকে খোঁজে পাব বলে মনে হয় না। চল, ঘরে ফিরি; কাকলিকেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওর পাছায় রক্ত ঝরছে, সেলাই দিতে হবে। দেরী করা ঠিক হবে না।”

কাকলি নামটা কানে আসতেই ইমামের শরীরটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর যেন হঠাৎ বজ্রপাত হলো। এ তো সেই কাকলি! ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে একসাথে ক্লাসে বসে আসছে তারা। কতদিনের পরিচয়, কতদিনের একসাথে পড়া, হাসি-আড্ডা। এখন তারা দশম শ্রেণীতে। কাকলির বাড়ি ছৈয়দিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে রেহানীয়া গ্রামে। এতদূরের পথ হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে আসা সম্ভব নয় বলে সে খালুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে।

ক্লাসের ভেতরে ইমামের দৃষ্টি যতবারই কাকলির দিকে গিয়েছে, ততবারই তার মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন উঠেছে। লাজুক অথচ চঞ্চল মেয়ে কাকলি- যার হাসি সবার মাঝে আলো ছড়াতো। সেই কাকলিকে ইমাম নীরবে ভালবাসতে শুরু করেছে তিন মাস হলো। একতরফা প্রেমের সেই বীজ তার বুকের ভেতর এমনভাবে শেকড় গেঁথেছে যে, প্রতিদিন সে নতুন করে স্বপ্ন আঁকত- কোনো একদিন মুখ ফুটে বলবে, “কাকলি, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।”

কিন্তু আজ, সেই স্বপ্ন যেন রক্তে ভেসে গেল। কাকের দিকে ছুঁড়ে মারা তার হাতের ইটের টুকরা গিয়ে আঘাত করেছে কাকলির পিঠের নিচে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার জামা। ব্যথায় কাকলির চিৎকার এখনও ইমামের কানে বাজছে। অথচ সেই আঘাতের উদ্দেশ্য ছিল না কাকলি- ছিল সেই ধূর্ত কাক।

ইমামের বুকের ভেতর অপরাধবোধের ঝড় বয়ে গেল। যাকে সে মনের গভীরে নিভৃতে পূজা করেছে, যাকে নিয়ে অগণিত কল্পনা বুনেছে, তাকেই সে আজ রক্তাক্ত করেছে! কী করে সে কাকলির সামনে দাঁড়াবে? যদি কাকলি জেনে ফেলে যে, এই আঘাতের নায়ক ইমাম নিজেই, তাহলে কি আর কখনো তার চোখের দিকে তাকাবে?

মুহূর্তেই মনে হলো, সবকিছু শেষ হয়ে গেল। তার বুকের গভীরে জমে থাকা সেই মধুর ভালবাসা কি এখন আর মুখে আনা সম্ভব? আজ যদি সে বলে, “কাকলি, আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি”- তাহলে কাকলি কি শুনবে? নাকি সে চোখ ফিরিয়ে নেবে, মুখ ঘুরিয়ে দেবে, আর ইমামের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে দেবে?

ইমাম বুঝল, এ শুধু একটা ইটের টুকরো নয়- এ যেন তার ভালবাসার পথে পড়ে থাকা এক বিশাল পাথর, যা হঠাৎ করেই সব স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।

ইমামের চোখ জোরে মেজাজি হয়ে উঠল- লোকগুলো ফিরে যাচ্ছে, মর্মে সে বুঝল। একটু চেক দিতে চেয়েই মাথা কুঁচকে, যেন কারো নজর এড়িয়ে, সে সাবধানে মাথা উঁচু করে চারপাশে তাকাল। ধানক্ষেত- সোনালি-সবুজ ঢেউয়ের মত মৃদু নড়াচড়া করছে; কিন্তু দীর্ঘক্ষণ পাশে পাশে কোনো সাড়া–শব্দ নেই। কিশোরদের কোলাহল এখন দূরে; কৌতুক আর আড্ডার গন্ডি ছেড়ে সবাই যেন ফিরে গিয়েছে, নীরবতা আবার ধানচর জুড়ে ঢুকে পড়েছে।

হাওয়ার মিষ্টি ঝাপটা গলায় লাগল- পায়ের তলায় মাটি খানিক কচিকচ করে। ইমামের মনে হলো, পৃথিবী তারই জন্য কমে এসেছে; ধানগুলোর মাঝেই যেন এখন শুধু সে আর তার অপরাধ রয়ে গেছে। নিজের বিবেককে সে কাঁধে তুলে এনে কোন রকম প্রশ্ন ছুঁড়ল- স্বরে নয়, মনে: “এই এক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত, ওই ইট ছোঁড়া, কি কিনা সারাজীবন আমাকে তাড়া করে বেড়াবে?” শব্দটা জোরে উচ্চারিত না হলেও ভাবের তীব্রতা কাঁটা জাগাচ্ছিল।

সে মনে করার চেষ্টা করল- কী ছিল কারণ? ক্ষোভ? কৌতুক? নাকি শুধু অমিত সাহসবিহীন একটি হাসি? ওই ইট ছোঁড়াটা যেন এখন একটি কণ্ঠরোধী রেকর্ড- বার বার প্লে হচ্ছে তার মনের ভিতরে। প্রতিটি ফ্রেমে দেখা যায় কাকের পাখা, সাবান, কাকলির সোনালি রং, ও তারপর- রক্ত ও চিৎকার।

ইমামের গা কাঁপছে, কিন্তু তা শুধু শারীরিক কাঁপন নয়; তা ছিল লজ্জা আর অপরাধবোধের কাঁপুনি। সে দেখতে পেল- তার এ ভুল সিদ্ধান্তের ফলাফল কেবল একটি সরল ঘটনা নয়; তা মানুষকে ধাক্কা দেওয়ার মতো একটি ঝলকানো আঘাত, যা কাকলির শান্ত মনকে চিরতরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করলেই ইমামের মনে ভেসে উঠছিল- কাকলির রক্তে ভেজা কাপড়, চারপাশের বিরক্তিকর শব্দ, আর নিজের সেই হাত, যেটা দিয়ে সে ইট ছুঁড়েছিল। সবকিছু যেন একসাথে ফিরে এসে তাকে তাড়া করছিল।

ধীরে ধীরে সে ধানের সারিতে পায়ের নীচে কাঁচা মাটি ছুঁয়েই হেঁটে গেল। প্রতিটি পায়ের চিহ্ন যেন অশান্তি আর অনুতাপের চিহ্ন ফেলছে ধান ক্ষেতের জমিতে। সে জানে- এখানে দাঁড়িয়ে আর কী করা যায়? এই জমি কখনো ক্ষমা সইবে না; মানুষের মনে যে ক্ষত হয়েছে, সেটার ক্ষত আর মাটির উপর পড়া চিহ্নে মিলিয়ে ফেলা যায় না।

তবু বাঁচতে চাওয়ার একটা তাগাদা ছিল- এটা কেবল লজ্জা নয়; মনে একটা জরুরি সংকেতও ডাকছিল। ইমাম বুঝে গেল, গোপনে লুকিয়ে থাকলে কোনো উপায় নেই, এখনি কাকলি আর তার পরিবারে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। যদি সে চुप থেকে যায়, দোষ-দাম চুকাতে হবে পরে আরও কঠিনভাবে। সময় তার পক্ষে নেই।

তার মনে এক অদ্ভুত ভীতিও কাজ করছিল- যতক্ষণ সে চুপ থাকবে, ততক্ষণ তার ভেতরের ভালোবাসা বিষে পরিণত হবে; আদর্শ, সুন্দর কথাগুলোই ধীরে ধীরে টক হয়ে যাবে। তাই এখনই ইমামের করণীয় একটাই: সাহস করে ও কুক্ষিগত লজ্জা ভেঙে কাকলির কাছে এসে ক্ষমা চাওয়া, নিজের ভুল মেনে নেওয়া এবং যা করণীয় সেটা করা- চাইলে বাড়তি সাহায্য করা, চিকিৎসা করায় বা ক্ষতটুকু সারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। এসব না করলে, পরেও তার আত্মা শান্তি পাবে না; তবে সামনাসামনে ক্ষমা চাইলেই হয়তো সম্পর্কের ভাঙা টুকরো জোড়া লাগার সুযোগ পাওয়া যাবে।

নীরব ধানক্ষেতের মাঝেই, সূর্য অস্তমিত আকাশের লালছায়ায়, ইমাম বুঝল- অপরাধের ওজন তাকে ভেঙে ফেলতে পারে, কেবল ক্ষমার রাস্তাই হারানো সম্পর্ককে ফিরিয়ে আনতে পারে। হৃদয়ের অন্দরে সে ধীরে ধীরে এক সংকল্প তৈরি করল; যা ছিল তৎক্ষণাত আর কৌতুকসুলভ, তা এখন জীবন হিসেবে ধরা। আজ যে ভুলটা করেছে, তার দায় নিতে হবে- চোখে চোখ রেখে, গলা কাঁপতে-কাঁপতে, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস মিলিয়ে।

সে ধানক্ষেত ছেড়ে হাঁটতে লাগল- প্রতিটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছিল, যেন ভবিষ্যৎকে সে টানছে, অথচ একই সঙ্গে সেই ভবিষ্যৎ থেকে পালাচ্ছে। মনে করিয়ে দিল- কখনো ছোট একটি কাজই বড় মর্মান্তিক প্রভাব ফেলে। ইমাম জানে আজকের রাত তার জীবনটা বদলে দেবে – এখন থেকে কী করবে তা নির্ভর করবে তার ওপর: সে কি কাকলির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে না লজ্জায় চুপ করে থাকবে, নীরবতা বজায় রাখবে না সত্যি কথা স্বীকার করবে।

তবু সেই মুহূর্তে ভেতর থেকে এক ছোট্ট আশা জাগল-  মানুষ প্রথমে রাগ করে, কিন্তু পরে সেটা মেনে নেয় আর শান্ত হয়। আহত মেয়েটির প্রতিক্রিয়া, হাসপাতালের শীঘ্রই আগমন- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হতে শুরু করল। ইমাম বুঝতে পারল, লোকজন মারধরের চেয়ে কাকলির চিকিৎসা চাইছে; আর হয়তো এজন্য উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত হতে লাগল। সেও বাঁচল- কিন্তু বাঁচার সঙ্গে সঙ্গে তার ভিতরে জন্ম নিল তীব্র অনুশোচনার খাদ।

সে বেশি কিছু না ভেবে ধানের কুঁড়ি আর মাটির গন্ধে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলল। চোখের পানি ছিল শুধু দুঃখের নয়, নিজের ভুল আর অন্যায়ের ভারেও ভরা। সে বুঝতে পারল, এই ভুল শুধু আজ নয়- তার পুরো জীবনকেই বদলে দেবে।

এরপর যা হলো- গ্রামবাসী কাকলিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, ইমাম অবশেষে চুপচাপ বাড়ি ফিরল; পথে প্রতিটি পদক্ষেপে যেন তার পা ভারী হয়ে পড়ল। গ্রামের গলি ঘুরতে ঘুরতে ইমাম বুঝল- সেদিন কাকের অপ্রত্যাশিত কাজ আর তার নিজের ভুলের কারণে দুই জনের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- একজন মেয়ের শরীরে আঘাত লেগেছে, আর একজন কিশোরের মনও আহত হয়েছে।

এভাবে, একটি ছোট্ট কাকের কাণ্ড যে এক জোড়া জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে- এ কথাই ইমাম সেই দিন শিখল, আর তার থেকে হারানো নিঃশব্দ বেদনাকে সে আর ফিরে পায়নি।

পরদিন স্কুলে গিয়ে ইমাম অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করল। ক্লাসের বেঞ্চে বসে বারবার চোখ মেলে খুঁজল কাকলিকে- যে মেয়ে সাধারণত প্রথম সারিতে বসে খাতা খুলে পড়াশোনায় মন দিত। কিন্তু আজ নেই। বুকের ভেতর হালকা এক অস্থিরতা জমল। তিন দিন পর টেস্ট পরীক্ষা, অথচ কাকলি নেই! চারদিকে ফিসফিস শুরু হয়ে গেছে- “কাকলি অসুস্থ…”। এই খবর শুনে ইমামের বুকের ভেতর হুড়মুড় করে অপরাধবোধ আরো গভীরভাবে চেপে বসল। সে কাউকে কিছু বলতে পারল না, শুধু মাথা নিচু করে বসে থাকল।

ক্লাস ক্যাপ্টেন রনিকে সে আস্তে করে প্রস্তাব দিল,
“আমরা কাকলিকে দেখতে যাব? অন্তত তাকে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত।”

রনি প্রথমে একটু চুপ করে থাকল, তারপর রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চাঁদা তোলার সিদ্ধান্ত হলো- প্রতি জন দশ টাকা। যারা দিতে পারল না, তাদের জন্য ইমাম নিজের পকেট থেকে দিয়ে চাঁদার প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করল, যেন কেউ বাদ না পড়ে। স্কুল ছুটির পর প্রায় ত্রিশ জন বন্ধু-বান্ধব একসাথে কাকলিদের বাড়ির পথে হাঁটা দিল। হাতে ছোট্ট ঝুড়ি- ফল আর একটা হরলিক্সের জার।

কাকলিদের বাড়ি পৌঁছানোর পর সবাই একটু ইতস্তত করল। দরজার সামনে নীরবতা, মনে হচ্ছিল ঘরটিও যেন কষ্টে নিমগ্ন। কিন্তু ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দৃশ্যটা অন্য রকম হলো। বিছানায় শুয়ে থাকা কাকলি আমাদের দেখে ধীরে ধীরে উঠে বসল। মুখে ফ্যাকাশে ভাব, তবুও এক টুকরো হাসি ফোটাতে চেষ্টা করল। সে হাসি যেন ব্যথার ভেতর থেকে জন্ম নেওয়া এক আলো, যা আমাদের সবার মন মুহূর্তেই হালকা করে দিল।

রনি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“কাকলি, তোমার কী হলো? আমরা সবাই চিন্তিত।”

আমি তখন হঠাৎ বলে উঠলাম,
“মেয়েদের অসুস্থতার কারণ জিজ্ঞেস করা উচিত না।”

কিন্তু কাকলি নিজেই আগ বাড়িয়ে বলল,
“কাল পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ কোন এক শয়তান আমার দিকে ঢিল ছুঁড়ে। ঢিল গিয়ে সোজা মাঝায় লাগে। চামড়া ছিঁড়ে রক্ত ঝরে, পরে তিনটা সেলাই দিতে হয়েছে।”

ঘরে নীরবতা নেমে এলো। বন্ধুদের চোখে বিস্ময় আর ক্ষোভ জমে উঠল।
রনি প্রশ্ন করল,
“তুমি তাকে দেখনি?”

কাকলি মাথা নেড়ে বলল,
“না, দেখার সময় পাইনি। ব্যথায় আর রক্ত দেখে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। খালু আর খালা আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। পরে শুনেছি ভাইয়া আর ছোট কাকা শয়তানটার খোঁজে ছুটেছিল, কিন্তু খুঁজে পায়নি।”

এই সময় সানু উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“পরশু টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে তো?”

কাকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল-
“এখনই কিছু বলতে পারছি না। সুস্থ না হলে খালু হেডস্যারের সঙ্গে আলাপ করে বিকল্প পথ খুঁজবে। নইলে অসুস্থ শরীর নিয়েই পরীক্ষা দিতে হবে।”

সবাই চুপ। হঠাৎ রাফুলের কণ্ঠ ভেসে এলো, যেন গোপন কোনো স্মৃতি খুলে বলছে-
“মানুষের বিপদ বলে-কয়ে আসে না, হঠাৎ করেই এসে যায়। গত বছর এই দিনে আমারও একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।”

সবাই তাকাল তার দিকে। রাফুল গম্ভীর হয়ে বলল,
-“আমি পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিলাম। সাবান মেখে ডুব দিয়েছি, হঠাৎ দেখি একটা কাক এসে আমার সাবানটা মুখে নিয়ে উড়ে গিয়ে পাশের গাছে বসেছে। আমি সাবানটা ফেরত আনতে ঢিল ছুঁড়লাম। কিন্তু ঢিল কাকের গায়ে লাগল না- গিয়ে লাগল আমার আট বছরের ছোট ভাগ্নের মাথায়।”

সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। রাফুলের কণ্ঠ থরথর করছে।
– “ভাগ্নের মাথা ফেটে গেল, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বলল মাথার ভেতর আঘাত লেগেছে। কিছুদিন সে সব কিছু ভুলে গেল, এমনকি নিজের নামও চিনত না। কত চিকিৎসা করালাম, এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে বটে, কিন্তু আগের মতো আর হয়নি।”

ঘর ভারী হয়ে উঠল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যেন বুঝতে পারল- একটা ছোট্ট ভুল, একটি অসতর্ক ঢিল- কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

ইমাম সবার ভিড়ে দাঁড়িয়ে রইল, মুখ নিচু করে। বুকের ভেতর আরও ভারী হয়ে উঠল তার অপরাধবোধ। কাকলি জানে না সেই “শয়তানটা” কে ছিল, কিন্তু ইমাম জানে। আর সেই গোপন সত্য তাকে ভেতরে ভেতরে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল।

রাফুলের কথাটা শুনে ইমামের বুকটা যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। মনে হলো ধারালো তীরের ফলা বারবার এসে তার হৃদয়ের ভেতরে বিঁধছে। “আমি যে ঘটনাটা আজও কাউকে বলিনি- সেই ঘটনাই হুবহু রাফুল বলছে কেন? ও কি আমার কাণ্ডটা জেনে গেছে? নাকি কাকের পিছু নিতে গিয়ে এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে, আর সবাই তাই ভেবেই বলে?’’

ইমাম নির্বাক হয়ে গেল। কিন্তু সত্যি কথা হলো- কাকলির উপর এই অনিচ্ছাকৃত অপরাধের দায়ভার তার কাঁধেই। ঢিলটা যদি কাকলির মাথায় গিয়ে পড়ত, হয়তো আজ তাকে আমরা এই ঘরে বসে দেখতে পেতাম না! ভাবতেই গা শিউরে উঠল। বুকের ভেতর অস্থির এক গ্লানি ঘূর্ণির মতো পাক খেতে লাগল। ইমামের চোখ-মুখ বিষণ্ন হয়ে এলো।

ঠিক তখন রনি বলল,
-“কাককে ঢিলা মারা ঠিক না। কাক সাবান মুখে নিয়ে পালাবে, কিন্তু ঢিল যাবে অন্য কোথাও- আর সেই ঢিলই বিপদ ডেকে আনবে।”

রনি এবার রাফুলের দিকে তাকাল,
-“তোর ভাগ্নে ঘটনাস্থলেই মারা গেলে, তুই কী বিপদে পড়তি ভেবে দেখেছিস?”

ঘরটা নিস্তব্ধ। ইমাম ভেতরে ভেতরে কেঁপছিল। কাকলি হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“এই ইমু, তুই এত কী ভাবছ? কথা বলছিস না কেন?”

ইমাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কাঁপা গলায় বলল,
-“না, কিছু না… কিছুই ভাবছি না।”

তার কথার আগেই বন্ধু সানু মুচকি হেসে যোগ করল,
-“ও যেন কাকলির অসুস্থতায় অন্য সবার চেয়ে একটু বেশিই চিন্তিত!”

সানুর মুখ থেকে কথাটা বের হতেই চারপাশে হাসি ফেটে পড়ল। ইমাম লজ্জায় মাথা নিচু করে মুখ লুকাতে চাইল। বুকের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল, আর চোখে গরম পানি ভেসে এলো। কাকলিও সানুর কথায় অস্বস্তি পেয়ে চুপ করে গেল।

ইমাম যে কাকলিকে খুব ভালোবাসে- এ সত্যিটা কেবল সানুই কিছুটা আঁচ করে। ইমাম এখনো কাকলিকে কিছু বলেনি। কতদিন ধরে ভেবেছি কীভাবে বলবে, কখন বলবে- সে চিন্তায় ঘুম হারাম হয়েছে। অথচ এই দুর্ঘটনাটা যেন ইমামকে আরও পিছিয়ে দিল। কাকলি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সে কি তাকে বলতে পারবে-
আই লাভ ইউ, কাকলি!”

ঠিক তখন কাকলির খালু ঘরে ঢুকলেন। তার মুখে কঠোরতা, চোখে এক ধরনের প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। সবাই চুপ হয়ে গেল।

খালু হাসিমুখে বলল,
-“বাবারা, তোমরা গল্প কর। তোমাদের জন্য নাস্তা রেডি করছি। না খেয়ে কেউ যাবে না।”

সবাই প্রথমে একটু দ্বিধায় পড়ল। রাফুল বিনয়ের সাথে উত্তর দিল,
-“না খালু, আমরা এতগুলো ছেলে একসাথে হঠাৎ চলে এসেছি। আপনাদের কষ্টের মাঝে এসে আর কষ্ট বাড়াতে চাই না। আমরা এখন উঠি।”

ওরা সবাই ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেল। খালু বারবার অনুরোধ করলেও, শেষ পর্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিয়ে চলে এল। খালুর আতিথেয়তার উষ্ণতা সবাইর বুক ভরিয়ে দিয়েছিল, অথচ ক্ষুধা নয়, কৃতজ্ঞতা নিয়েই সবাই ফিরে আসল।

এদিকে কাকলি তখনও অসুস্থ শরীর নিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল। প্রতিদিন পরীক্ষার হলে গিয়ে ইমাম সহপাঠী মেয়েদের বলে দিত যেন কাকলিকে রিকশা থেকে নামিয়ে এনে সিটে বসায়। পরীক্ষা শেষে আবার তাকে রিকশায় তুলতেও ইমাম গোপনে তদারকি করত। কাকলি বুঝতে না পারলেও, হয়তো তার অদৃশ্য যত্নের স্পর্শে কাকলি একটুখানি হলেও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে তার প্রতি।

দিন কেটে যাচ্ছিল দ্রুত। সবার এসএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। অথচ ইমামের বুকের ভেতর জমে থাকা কথা একবারও কাকলিকে বলা হলো না। কতবার ভেবেছে- আজ বলব, আজই জানাবে তার মনের কথা। কিন্তু প্রতিবার তার সামনে দাঁড়িয়ে সাহস হারিয়ে ফেলেছে। একা পেয়েছে বারবার, তবুও ঠোঁটগুলো যেন আটকে গেছে।

ইমাম বুঝেছিলা- যার নিজের ভেতরে সাহস নেই, যে সবসময় ভীরু হয়ে থাকে, সে ভালোবাসায় প্রাণ দেবে কোথা থেকে? যার বুকভরা কষ্টের আলপনাগুলো লুকিয়ে থাকে নিজের অন্দরেই, সে কীভাবে অন্যের কাছে ফুটিয়ে তুলবে নিজের হৃদয়ের নিষ্প্রাণ ও সুপ্ত ভালোবাসার বানী?

ইমাম তেমনই একজন ব্যর্থ প্রেমিক। ভীরু প্রেমিক।
তার ভালোবাসা জন্মেছিল, বেড়ে উঠেছিল, কিন্তু বলার সাহস পেল না। কাকলির দিকে তাকালেই তার মনে হতো- “সে আমারই জন্য, অথচ এক চিলতে সাহসের অভাবে তাকে কাছে টানতে পারিনি। এ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়, আর সেই পরাজয় নিয়েই আমি বাঁচতে শিখেছি।“

সময় গড়িয়ে যায়। ইমাম ইতোমধ্যেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ঢাকায় এক নামী কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। কাকলিও হাতিয়ার বিস্তৃত নদীঘেরা মায়া ছেড়ে এসএসসির পর শহরে পড়াশোনার স্বপ্নে চট্টগ্রাম চলে আসে। হাতিয়ায় যাদের শৈশব, কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত – ইমামের এখন সেখানে ফেরা হয় শুধু দুই ঈদের ছুটিতে। কাকলি এসএসসির পর হাতিয়ায় যাওয়া হয় নি।

কাকলির সাথে ইমামের আর কোনোদিন দেখা হলো না। না কোনো যোগাযোগ, না কোনো চিঠিপত্র। তবুও প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তার অস্পষ্ট ছায়া তার চোখের মণিকোঠায় ভেসে থাকত। একদিন ঈদের ছুটিতে হাতিয়া গিয়ে কাকলির খোঁজ করেছিল। জানতে পারে- এসএসসি পরীক্ষার পর সে খালুর বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে গেছে। তার বাবা বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা; চট্টগ্রামেই তারা নতুন বাড়ি করেছে। তারপর থেকে আর হাতিয়ায় ফেরেনি। যেন এরপর থেকে তাদের মাঝের সব সেতু ভেঙে পড়ল।

ঢাকায় চাকরি নেবার পর থেকে ইমামের বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল। কখনো পরিবারের পক্ষ থেকে, কখনো কনের পরিবারের পক্ষ থেকে। অধিকাংশই হাতিয়ার পরিবার, যারা নদী ভাঙ্গনের জায়গা-জমি হারিয়ে হাতিয়া ছেড়ে বাইরে বসতি গড়েছে। প্রতিবার ইমাম নানান অজুহাতে প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেয়। মনে হতো- কোনো কিছুতেই মন বসছে না, মনে হতো সে এখনও কাকলির কোনো অদৃশ্য ছায়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বার বার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ও তার খুঁতখুঁতে মনোভাব দেখে একসময় সবাই বিরক্ত হয়ে গেল। অনেক দিন আর কেউ আর  জন্য মেয়ে দেখল না।

তার বিয়ে নিয়ে পরিবারের মাতামাতি যখন একেবারে স্তিমিত হয়ে এলো, তখন হঠাৎ একদিন তার বড় দুলাভাই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন। ইমাম তখন তাদের ভাড়া বাসায়। সে লক্ষ করল- দুলাভাই তার আম্মার রুমে ঢুকে দরজা এঁটে ফিসফিস করে আলাপ করছেন। সে কদমবুচি করার জন্য দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দুলাভাই হাসিমুখে বের হলেন।

ইমাম সালাম করতেই দুলাভাই তাকে টেনে তুলে চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন-
“এবার যদি খুঁত খোঁজার চেষ্টা করো, তাহলে মনে রেখো- তোমার কপালে আর কোনোদিন বউ জুটবে না!”

কথাগুলো ইমাম বুকের ভেতর ঢেউ তোলে। হঠাৎ ভাবল- “আমার বয়স তো ইতোমধ্যেই ছত্রিশ ছুঁই ছুঁই। আর কত কালক্ষেপণ করব? জীবন তো থেমে থাকে না।“

সে দুলাভাইকে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি আর আপা যাকে পছন্দ করেন, আমার কোনো আপত্তি নেই। আলাপ ফাইনাল করুন।”

তার উত্তর শুনে দুলাভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি খুশিতে ভরে বিকেলেই আবার চট্টগ্রাম ফিরে গেলেন। পরদিন ফোন করে জানালেন- ইমামকে যেন কালই চট্টগ্রাম যেতে হবে।

ইমাম আর দেরি করল না। রাতের ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাত্রির আঁধারে ছুটে চলা গ্রাম আর জনপদ দেখতে দেখতে ভাবছিল- “এটাই কি তবে আমার জীবনের নতুন বাঁক? ভাগ্য কি অবশেষে আমাকে অন্য কোনো রঙে রাঙাতে চাইছে?”

চট্টগ্রাম পৌঁছে জানতে পারল- আজ রাতেই তার বিয়ের আয়োজন! অবাক বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে সে। এত তাড়াহুড়ো করে বিয়েও হয় নাকি? আপা-দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে দেখে আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে মুখর চারদিক। চেনা-অচেনা অনেক মুখ, হাসি-ঠাট্টা, প্রস্তুতির ব্যস্ততা- সব মিলিয়ে এক উৎসবের আমেজ।

আর সেই মুহূর্তে যেন ইমাম নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে উৎসব, ভেতরে তার মন ঘূর্ণিঝড়ের মতো। ভাবতে লাগল- “যার স্বপ্ন একদিন কাকলি নামের এক কিশোরীর চোখে বন্দি ছিল, যার প্রেম কখনো প্রকাশ করতে পারলাম না, সেই আমি আজ জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছি।“

রাতভর সফরে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। তাই ভোরে ঘুমিয়ে পড়ে। চারদিকে কী আয়োজন হচ্ছে, কারা আসছে, কে কী করছে- সবকিছু থেকে সে দূরে থাকল। ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল, সে যেন কোনো অচেনা স্বপ্নের ভেতরে ভেসে আছে, যেখানে তার জীবন অন্য কারো হাতে রঙ পেতে চলেছে।

দুপুরে দীর্ঘ ঘুম ভাঙতেই কান ভরে উঠল আত্মীয়-স্বজনদের কলরবে। ড্রইংরুমে খালাদের বিশাল আড্ডা জমে উঠেছে। সে পা টিপে পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই এক খালা মজা করে বললেন-
-“এই যে বরমশাই! এত লাজুক কেন? এসো, তোমার গায়ে হলুদ দিতে হবে।”

ইমাম একেবারেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। মুখের কোণে অপ্রস্তুত হাসি, গালে হালকা লজ্জার আভা, আর চোখে যেন অচেনা অস্বস্তির কুণ্ঠা। দুপুরে গায়ে হলুদের ধুমধাম শেষে হঠাৎ খবর পেল- রাতেই মূল বিয়ের পর্ব সম্পন্ন হবে।

খবরটা শুনে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত আলোড়ন জেগে উঠল। আনন্দ, উৎকণ্ঠা আর দায়িত্বের অদ্ভুত মিশ্রণে মন ভরে গেল। বিকেল নামতেই সে গোপনে একটা রিকশায় চড়ে বেরিয়ে পড়ল। ব্যস্ত নগরীর ভিড় ঠেলে পৌঁছাল কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর কাছে।

নিজ হাতে, বিনীত অথচ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমন্ত্রণ জানাল-
“আজ আমার জীবনের বিশেষ দিন। তোমরা না এলে পূর্ণ হবে না।”

বন্ধুরা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল, তারপর হেসে উঠল। আনন্দে সবার চোখ চকচক করে উঠল। সবাই রাজি হলো, যেন তার সুখের অংশীদার হওয়ার সুযোগ হারাতে চায় না কেউ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আগ্রাবাদ কমিউনিটি সেন্টারের ঝলমলে আলোয় ভরে উঠল চারপাশ। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী- সবাই মিলে উৎসবের ভিড়। নিকাহর কলেমার মিষ্টি উচ্চারণে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। সবার দোয়া আর হাসির মাঝে যেন আশীর্বাদের বৃষ্টি নেমে এলো।

তারপর এল ভোজের ধুম। টেবিল ভরে গেল নানা রকম সুস্বাদু খাবারে। হাসি-আড্ডা, খাওয়ার রসনা, মধুর ব্যস্ততা- সব মিলেমিশে সন্ধ্যা থেকে রাত হয়ে গেল এক অদ্ভুত ঝাপসা ঘোরের ভেতর। ইমাম যেন বুঝতেই পারছিল না, সময় কখন তার হাতে থেকে ফসকে যাচ্ছে।

সবশেষে, কোলাহল আর শুভেচ্ছার ভিড় পেরিয়ে নববধূকে নিয়ে ইমাম ফিরল খুলশিতে, তার আপার বাসায়। রাত তখন গভীর হয়ে এসেছে। রাস্তাঘাট নির্জন, অথচ ইমামের হৃদয় ভরে আছে আলোয়- নতুন জীবনের আলো, প্রতিশ্রুতির আলো, ভালোবাসার আলো।

এমন এক রাত, যা শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জীবন ও ভবিষ্যতের এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দিল তার সামনে।

ভাগ্নে-ভাগ্নিরা আগেই সাজিয়ে রেখেছিল বাসরঘর। চারপাশে টাটকা ফুলের মালা, রঙিন লাইটের নরম ঝিলিক, আর বিছানাজুড়ে লাল-সাদা গোলাপের পাপড়ি। সব মিলিয়ে যেন রূপকথার রাজ্যের এক অভিনব দৃশ্য। বাইরে দাঁড়িয়ে সবার মুখে কৌতুকমাখা হাসি, ফিসফিস কথোপকথন- তাদের মজা যেন নতুন বরকে নিয়ে অশেষ। ইমাম শুধু চুপচাপ সেইসব হাসি-ঠাট্টা মেনে নিচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে বুকের ভেতর কাঁপন সামলাতে ব্যস্ত।

অবশেষে দরজা বন্ধ হলো। চারদিকে নেমে এলো নিস্তব্ধতা।
এক মুহূর্তে ইমামের বুকের ভেতর অদ্ভুত ধুকপুকানি শুরু হলো। এ ঘরটা এখন শুধুই তার আর তার নতুন বউয়ের।

দরজার আড়াল পেরিয়ে ঘরে পা দিতেই মনে হলো, এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে সে। ঘর ভরে আছে ফুলের গন্ধে, রঙিন আলোয় সাজানো পরিবেশ যেন অন্য জগতের। নিজের ঘর হলেও সাজসজ্জার চাকচিক্যে মনে হচ্ছে অপরিচিত কোনো রাজমহল।

ইমাম একটু দ্বিধায় পড়ল। বাতিটা নিভিয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু আবার মনে হলো- প্রথম রাত, প্রথম পরিচয়, আলো থাকাই ভালো। আলোয় যেন সত্যিটা আরও সুন্দরভাবে ধরা দেয়।

চোখ ফেরাতেই সে দেখল- সে বসে আছে শান্তভাবে, নিঃশব্দে। দিনের পরিশ্রমে চোখে জমে আছে ক্লান্তি, মুখে নেই কোনো সাজসজ্জা, নেই আটা-ময়দার প্রলেপ কিংবা কৃত্রিম আভা। অথচ তাকে দেখাচ্ছে অপূর্ব সুন্দর- এক ধরনের স্বাভাবিক সৌন্দর্য, যেখানে লুকিয়ে আছে শান্তি আর প্রশান্তির গভীর ছাপ।

ইমামের মনে হলো- প্রকৃত সৌন্দর্য কৃত্রিমতার আড়ালে নয়, বরং ঠিক এই সরলতায়।

ইমাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“তুমি কৃত্রিম সাজগোজে নিজেকে আড়াল করোনি, এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ না জানালে অন্যায় হবে।”

তার কথায় নববধূর ঠোঁটে ফুটে উঠল এক মৃদু হাসি। সেই ক্ষণিক হাসি ইমামের অন্তরে ঢেউ তুলল, যেন এক অচেনা সুর তার বুকের ভেতর বাজতে শুরু করেছে।
তবে তার চোখ এড়িয়ে গেল না- গালে হালকা ব্রণ, চোখের নিচে অনিদ্রার কালি, শ্যামলা রঙে মাখা সাধারণ মুখ। কিন্তু ইমামের কাছে সে আজ অপরূপা, কারণ সে নিজের স্বাভাবিকতাকেই বেছে নিয়েছে। সাজসজ্জার আবরণ নয়, বরং প্রকৃত সত্ত্বাকে সামনে আনার সাহসিকতাই তাকে আরও অনন্য করে তুলেছে।

ইমাম আলতো করে তার হাত স্পর্শ করল। স্পর্শে নববধূর ভরসা যেন গলে গিয়ে ইমামের বুকে আশ্রয় নিল। মুহূর্তটি হয়ে উঠল গভীর, নিরাভরণ ভালোবাসার প্রতীক।

কিন্তু হঠাৎ-
তার দৃষ্টি গিয়ে আটকাল এক অচেনা দাগে। শরীরের গোপন এক প্রান্তে পুরোনো সেলাইয়ের চিহ্ন।
ইমামের শরীর যেন মুহূর্তেই শীতল বরফে ঢেকে গেল। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল এক অজানা আতঙ্ক। মনে হলো, হঠাৎ করেই সে প্রবেশ করেছে অচেনা এক অতল খাদে।

তবুও, মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিল সে। সমস্ত আকাঙ্ক্ষা, সমস্ত বাসনা এক গভীর নীরবতায় গিলে ফেলে ফিরে গেল প্রথম আলাপের সহজ কথোপকথনে। যেন রাতের নিস্তব্ধতায়, আলো-অন্ধকারের মিশ্র খেলায়, তারা দুজন ধীরে ধীরে শিখছে- ভালোবাসা কেবল শরীরের নয়, হৃদয়েরও এক অঙ্গীকার।

সে হয়তো ভেবেছে- ইমাম লাজুক, কিংবা এখনও নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারছে না। কিন্তু আসলে তার ভেতরে তখন এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় বয়ে চলেছে।
মুখে শান্ত, চোখে নিরীহ হাসি- কিন্তু বুকের ভেতর ঢেউ থেমে নেই।

ইমাম কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না। আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল-
“তুমি লেখাপড়া কোথায় করেছো?”

সে মৃদু হাসল। কণ্ঠে কোনো দ্বিধা নেই, ভরাট ও নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলল-

“আমার এসএসসি হাতিয়ায়, এইচএসসি আর ডিগ্রি করেছি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে। এখন জনতা ব্যাংকে কাজ করছি।”

“এসএসসি হাতিয়ায়—”
শব্দদুটো যেন হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আঘাত করল ইমামের হৃদয়ে।
“হাতিয়া” -এই নামেই বুকের ভেতর অচেনা এক উত্তেজনা গোপনে রক্তে ঢেউ তুলল। অজান্তেই শরীরের পশম খাড়া হয়ে উঠল, নিঃশ্বাসে জমে উঠল এক ধরণের চাপা টান।

এক মুহূর্তেই মনে পড়ল অতীতের সেই ধূসর ছায়া- কাকলি।
শুধু নামের উচ্চারণেই স্মৃতির অন্ধকার কোণ থেকে ভেসে উঠল ঝাপসা চেহারা, অর্ধেক-ভোলা মুখ, এক অদ্ভুত সম্পর্কের অনুরণন।

বিয়ের দিনটিতে তো নববধূর মুখ পুরোপুরি খেয়াল করা হয়নি। পরিচয়ের সূত্রে শুধু শুনেছিল- সে চট্টগ্রামের মেয়ে। আর কানে বাজছিল কেবল একটি নাম- “কাকলি।”
দেশে তো শত শত, হাজারো কাকলি আছে। শুধু নাম মিললেই কি সবকিছু এক হয়ে যায়?

কিন্তু তবুও হৃদয়ের ভেতর এক অজানা আতঙ্ক ধীরে ধীরে শেকড় বিস্তার করতে লাগল।
মনে হচ্ছিল- অতীত ও বর্তমান হয়তো আস্তে আস্তে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে তাকে।

আর এখন সে বলছে সে এসএসসি করেছে হাতিয়ায়- কিন্তু হাতিয়ায় কোথায় পড়েছে, কবে? ইমামের মনে শত প্রশ্ন একসাথে জেগে উঠেছে।
– “তুমি কি ছৈয়দিয়া হাই স্কুলের ’৭৯ ব্যাচের সেই কাকলি?”

সে সূক্ষ্মভাবে বলল- “জি… কেন? কী এমন?”

ইমাম শব্দ খুঁজে পেল না, স্তব্দ হয়ে রইল।

তবে সে ইতিমধ্যেই কথা শুরু করে দিল- মানুষের জীবনের ছোট ছোট পটভূমি খুলে দেয়ার মতো স্বচ্ছ কণ্ঠে: “বাবা নৌ-বাহিনীতে চাকরি করেছেন, তাই আমরা পরে চট্টগ্রামে চলে এসেছি। যে দিন স্টিমারে উঠতে যাব তখন বাতানখালী-তে চাচার বাড়ির সামনে দাদার কবরটা দেখে আমি অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলাম- সেই ছিল হাতিয়ায় আমার শেষ কান্না। তারপর আর কখনও হাতিয়ায় যাইনি।”

ইমাম কড়া চোখে তাকাল- ওর কথাগুলো যেন সবকিছুকে ভাঙিয়ে ফেলল, ভাঙাল আবেগের সব বাঁধ। জিজ্ঞাসা করল- “কেন তুমি এত কেঁদেছিলে?”

কাকলি চুপ করে থাকল- চোখে দূরবৃত্তি, কণ্ঠে অশ্রুতে ভেজা গলাগলি। কিছুক্ষণ পর তখন সে বলল- “দাদার কবরটাকে মেঘনা রাক্ষুসীভবেই খেয়ে ফেলছে। কবরের যে বড় অংশ ছিল, নদী ধীরে ধীরে ভেঙ্গে নিয়ে গেছে; এখন শুধু দাদার দু’টো পায়ের হাড় দেখা যাচ্ছিল। দাদা ছিলেন লম্বা লোক- তাই হাড়গুলোও লম্বা। ওই দৃশ্য দেখেই আমি কেঁদেছি। কী নিষ্ঠুর এই জগত! হাতিয়া দ্বীপের মানুষ- যারা এতিম, যারা বাড়ি–ভিটে হারিয়েছে, তাদের আর্তনাদ যেন প্রতিনিয়ত মেঘনার পারে–পারেই বাজে; কবর পর্যন্ত মেঘনায় উধাও হয়ে যাচ্ছে।’”

তার কণ্ঠে একধরনের বিস্ময় আর অসহায়তাই ভাসছিল- মৃত্যুর স্মৃতি, ভূস্বর্গের অমানবিকতাকে কাঁপিয়ে ওঠা ব্যথা। ইমাম চুপ করে কথা শুনল; মনে হলো, ঐ সব ছবি তার নিজের চোখে ভেসে উঠছে- হালকা বালু, কাঁচা কাদামাটি, গাছের শিকড়ে মোড়ানো নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা কবরগুলো, আর তাদের পাশে স্বজনদের খোলসে বেরিয়ে থাকা হাড়গুলো- সবকিছু যেন তার ধ্যান-জ্ঞান কেড়ে নিচ্ছে।

কাকলি আবার বলল-
-“ওই দিন, আমি কাঁদছিলাম। শুধু আমারই কান্না নয়- হাতিয়ার হাজার হাজার মানুষের কান্না ছিল। তাদের দুঃখ যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, প্রতিনিয়ত আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দেয়।”

তার দাগ-কাটা কথাগুলো ইমামের হৃদয়কে বড় অচেনা ভাবে নাড়িয়ে তুলল। সে হঠাৎ বুঝল- “আমার কিশোর বয়সে যে নিঃসঙ্গ প্রেমটি হঠাৎ করে ম্লান হয়ে গিয়েছিল, তার পেছনে ছিল এমন এক কুঠুরি ইতিহাস- একখানা টিকে থাকা স্মৃতি, নদীর হাবভাব আর মানুষের হারানোর বিপর্যয়। কাকলি তখন অপ্রাপ্ত বয়সের মেয়ে তবুও তার ভেতরে অতীত এখনো পুরোটাই হারিয়ে যায়নি।

সে তখন চেয়ারে বসল, চোখের কোণে আর্দ্রতার ফোঁটা জমে আছে। টেবিল থেকে তুলে নিল এক গ্লাস দুধ। ইমাম কাকলির কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। তার কণ্ঠে একইসাথে একটা চাপা অস্বস্তি এবং এক ধরনের অস্বাভাবিক ভালোবাসা ফুটে উঠল। সে নীরবে তার দিকে তাকালো; তার চোখে এমন এক সহানুভূতি আর অকারণ মমতা ছিল, যা সচরাচর দেখা যায় না।

ইমাম কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না , শুধু মনে হলো- এই মানুষের অতীত, তার ভাঙা স্মৃতি আর নদীর ভাঙন- সবই এখনো তাকে ঘিরে আছে। বুঝলাম, আমার জীবনেরও এক অংশে এখনো হাতিয়ার আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাকলির কথা যেন আবার মনে করিয়ে দিল- নদী শুধু জমি বা স্থায়ী ঠিকানা কেড়ে নেয় না, কেড়ে নেয় ইতিহাস, নাম, স্মৃতি, আর শেষে মানুষের হাড়গোড়ও কেড়ে নেয়।

ওরা দু’জনে কিছুক্ষণ চুপ করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরে রাতের মানুষের কোলাহল, রাস্তার গাড়ির শব্দ, আর ওদের ভেতরের শান্ত কথোপকথন- সবই যেন এক অদ্ভুত ছন্দ তৈরি করছিল। ইমাম ভাবল, আজকের এই রাত, তার নতুন জীবন, আর অতীতের সেই কিশোরীর সাথে তার কথা- সবকিছু মিলে যেন একটা অদৃশ্য সাঁকো তৈরি হচ্ছে।

বাসর ঘরের মৃদু আলোতেও কাকলির চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন পুরো কক্ষটিকে এক বিষণ্ণ আবেশে সিক্ত করে তুলছিল। ইমাম লক্ষ্য করল, ক্ষণিকের মধ্যে ফুলের পাপড়িগুলোও যেন তাদের সজীবতা হারিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে নিস্তব্ধে ঝিমিয়ে পড়েছে। এমন এক নিবিড় মুহূর্তে তার মনে হলো, মেঘনার মতো কঠিন বাস্তবতার কথা তুলে এনে কাকলিকে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। তাই সে নিজেকে সামলে নিয়ে কথোপকথনটি ব্যক্তিগত স্মৃতির দিকে ঘুরিয়ে দিল।

ভেতরের চাপা উত্তেজনা সামলে নিয়ে ইমাম বলল, “তুমি তো তোমার খালুর বাড়িতে থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে এসএসসি শেষ করেছিলে, তাই না?”

কাকলি হঠাৎ তার দিকে তাকাল, চোখে বিস্ময় আর কিছুটা অবাক ভাব- “তুমি এসব কীভাবে জানলে?”

ইমাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল, কোনো উত্তর দিল না। মনে মনে ভাবছিল, কীভাবে এমন ছোটখাটো ঘটনা কেউ মনে রাখতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “টেস্ট পরীক্ষার দু’দিন আগে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে যখন তুমি সাবান মেখে গোসল করছিলে, তখন এক দুর্বৃত্ত ইট ছুঁড়ে তোমার নিতম্বে আঘাত করেছিল। তিনটি সেলাই লেগেছিল।”

কাকলি হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চোখে এক চিলতে অবাক ভাব, যেন সে কোনো ফকির বা আধ্যাত্মিক জগতের লোকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! মুখে মৃদু বিস্ময় নিয়ে একদৃষ্টে ইমামের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আরে! তুমি এসব কীভাবে জানলে, কে বলেছে তোমাকে?”

ইমাম তার দিকে ধীরে ধীরে তাকাল। মনে হলো, চোখে চোখ রাখলেই যেন সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। ভেতরের সব লুকানো অনুভূতি, দীর্ঘদিন ধরে চেপে রাখা ভালোবাসা- সব যেন খুলে বেরিয়ে আসছে। কণ্ঠে হালকা কাঁপুনি, কিন্তু স্থিরভাবে বলল, “তুমি আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, চিনতে পারছো কিনা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম। সাহস ছিল না, তাই কখনও বলতে পারিনি।”

কাকলির চোখে যেন আলোর ঝিলিক খেলে গেল, মনে হলো কিছুটা অবাক, কিছুটা লজ্জা মেশানো হাসি। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, “মুখভর্তি দাড়ি থাকলে কি চেনা যায়! তখন নিশ্চয় গোঁফ-দাড়ি ছিল না। তুমি আগে নিজের পরিচয় দাও।”

ইমাম একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “রাগ করবে না তো?”

কাকলির মুখে সামান্য খুশির ঝিলিক ফুটে উঠল। সে বলল, “রাগ করার তো আমি কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।”

ইমাম আরও সাহস সঞ্চয় করে বলল, “শোনো তাহলে। সেই দিন পুকুরঘাটে তোমার নিতম্বে ইট ছুঁড়েছিলাম আমিই। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত ছিল না, অনিচ্ছাকৃতভাবে তোমার গায়ে পড়েছিল।”

কাকলির চোখে বিস্ময় ও অবিশ্বাসের মিশ্রণ ফুটে উঠল। সে প্রশ্ন করল, “তাহলে সেই দুষ্ট ছেলেটা তুমিই? কেন সেদিন ঢিল ছুঁড়েছিলে? সেই সময় আমি শরীরের উপরের জামাকাপড় খুলে সাবান মাখছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে এমন দৃশ্য দেখে সইতে না পেরে ঢিল ছুঁড়েছো, বুঝি- ছি:!”

ইমাম কাঁপা কণ্ঠে বলল, “একদম ঠিক না। আমি তোমাকে দেখতেই পাইনি। সাবানচোর কাককে ঢিল ছুঁড়েছিলাম, তা গিয়ে পড়েছে তোমার গায়ে। তোমার চিৎকার শুনে আমি বুঝতে পেরেছি ঘাটে কেউ একজন ছিল, দেখার আগেই দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

কাকলির চোখে বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, “সাবানচোর কাককে ঢিল ছুঁড়েছি মানে?”

ইমাম বিষয়টি পুরোটা খুলে বলল, “শোনো, সেদিন দুপুরে আমি বাংলা ও কসকো সাবান নিয়ে আমাদের দরজার বড় পুকুরঘাটে গোসল করতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দুটো কাক ছোঁ মেরে আমার সাবান দুটো নিয়ে যায়। আমি ঢিল নিয়ে ওদের পিছু নিই। তারপর—”

কাকলির মুখে হঠাৎই হালকা হাসি ফুটল। সে বলল, “তাই! এতকিছু হয়ে গেল সেদিন। সামান্য কাক পাখি, অথচ ওদের কারণে তোমাকে ধানক্ষেতে পালিয়ে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছিল। আমিও রক্তাক্ত হয়েছিলাম। তাহলে তুমি সেই ইমাম হোসেন ইমু, ক্লাস ভর্তি এতগুলো ছেলে-মেয়ের সামনে অপলক দৃষ্টিতে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে, তাই না?”

ইমাম মাথা ঝুঁকিয়ে, লজ্জা ও ভালোবাসার মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ, আমিই সেই ইমু। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম। লজ্জায় মুখ ফুটে কখনও বলতে পারিনি। আমার এত বছরের স্বপ্ন আজ যেন পূর্ণতা পেয়েছে। দুলাভাই আমার কাঙ্ক্ষিত মনের সেই আঁচলেই আমাকে বেঁধে দিয়েছেন সবার অজান্তে। তাই উনার প্রতি আমি খুবই কৃতজ্ঞ।”

কাকলির চোখে অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বলতা, বিস্ময় ও শান্তি- সব মিলেমিশে ফুটে উঠল। সেই দীর্ঘদিনের লুকানো ভালোবাসা আজ প্রকাশ পেতে চলেছে। মুহূর্তগুলো যেন স্থির হয়ে গেল, আর তাদের চারপাশের পুরো রুমটিই যেন এই আবেগের সাক্ষী হয়ে রইল। ওরা দু’জনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসতে থাকে, অতীতের সব দ্বিধা, লজ্জা ও স্বপ্ন মিলিয়ে আজ নতুন অধ্যায়ের শুরুতে প্রবেশ করছে।

ওদের কথোপকথন ধীরে ধীরে গভীর হয়ে এলো, কাকলির চোখে মিশ্র অনুভূতি- আশ্চর্য, বিনয়, আর আনন্দ ফুটে উঠল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ছেলেদের চোখের দৃষ্টিবিন্যাস, হাবভাব, আঙুলের নড়াচড়া- মেয়েরা সহজেই সব বুঝে যায়। তুমি যে আমার প্রতি দুর্বল ছিলে, আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। একটা মেয়ে বুঝে থাকলেও না বোঝার ভান করে, অপেক্ষা করে কখন ছেলেটা নিজ থেকে বলবে- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ আর ছেলেটা যদি সেটা বলতে না পারে, তাহলে ভালোবাসার মৃত্যু ঘটে।”

কাকলির চোখে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা কৌতূহল, আর কিছুটা হাসির ঝিলিক ফুটল। সে আরও বলল, “মেয়েটা ‘না’ বলতে পারে- এই ভয়ে বেশিরভাগ ছেলে প্রপোজ করতে সাহস পায় না। সময় চলে যায়, মেয়েটার হয়তো অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। ভালোবাসি বলা একটি ছেলের জন্যও অত্যন্ত জটিল। কারণ আমরা মেয়েরা মান হারানোর ভয়কে সবচেয়ে বড় বিপদ মনে করি। তখনও তুমি আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলতে পারোনি।”

ইমাম তার দিকে তাকিয়ে বলল- “আসলে আমি খুবই লাজুক ও ভিতু স্বভাবের ছিলাম।

কাকলি বলল- “আমাদের এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হতো না। তুমি যদি সেই সময়ে লজ্জা ছেড়ে মুখ ফুটিয়ে বলতে পারতে, তাহলে হয়তো আমাদের বিয়ে সঠিক সময়ে সম্পন্ন হত।”

কাকলির চোখে স্নিগ্ধতা, লাজ, আর আনন্দের মিশ্রণ ফুটে উঠল। ইমাম ধীরে জিজ্ঞেস করল-

“তুমি কি তখনও আমার প্রেমে সাড়া দিত?”

কাকলির চোখে দীপ্তি বাড়ল, লজ্জা মিশ্রিত হাসি নিয়ে সে বলল-

“মেয়েরা আগ বাড়িয়ে সাড়া দেয় না। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত, যেহেতু তোমার পাজরের হাঁড় দিয়ে আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই হয়তো তখনও সাড়া দিতাম।”

ইমাম হালকা কণ্ঠে, কাকলির দিকে তাকিয়ে বলল-

“তুমি এতদিন বিয়ে করনি কেন?”

কাকলির চোখে সান্ত্বনা, হৃদয়ের উষ্ণতা আর দীর্ঘদিন লুকানো ভালবাসার প্রতিফলন- সব মিলিয়ে যেন ঘরের বাতাসকে উজ্জ্বল করে তুলল। এই মুহূর্তে বোঝা গেল, দীর্ঘ অপেক্ষা, লাজ, দ্বিধা- সব মিলিয়ে তাদের ভালোবাসা আজ চূড়ান্ত রূপ পেতে শুরু করেছে।

কাকলির চোখে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। সে যেন অতীতের স্মৃতি থেকে ফিরে এসেছে। কাকলি ধীরে ধীরে তার দিকে তাকিয়ে বলল- “সৃষ্টিকর্তা হয়তো তোমার অপেক্ষায় আমাকে বিয়ের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করার পর আব্বু আমার জন্য পাত্র খুঁজছিল। সেই সময় হঠাৎ আব্বু হৃৎ রোগে মারা গেল। উনার মৃত্যুর দুই বছর পর আমার জনতা ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার পদে চাকরী হয়। আমার ছোট আরো দুই ভাই ও দুই বোন। এতবড় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়ে হয়ে আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। ভাই-বোনদের পড়ালেখা, অসম্পূর্ণ বাড়ির নির্মাণ কাজ- সব শেষ করতে এতগুলো বছর কেটে গেছে। তাই বিয়ের কথা কখনো ভাবতে পারিনি।”

ইমাম নিঃশ্বাস থামিয়ে বসে আছে। কাকলির চোখে মিশ্র অনুভূতি- দুঃখ, দায়িত্ববোধ, এবং আত্মত্যাগের প্রশান্তি।

ইমাম বলল- “আমি তোমাকে আমার প্রেমের প্রস্তাব দেব ভাবছিলাম। কিন্তু সেই সময়, কাকের মুখ থেকে সাবান উদ্ধার করতে গিয়ে তুমি রক্তাক্ত হয়ে গেলে, প্রস্তাব দেওয়ার সাহস পাইনি। এসএসসি পরীক্ষার পরদিন তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে, তারপর থেকে তোমার সন্ধান পাইনি। মনে হচ্ছে দুষ্ট কাক শুধু সাবান চুরি করেনি, সে চুরি করেছে আমার ভালোবাসার মানুষটিকেও।”

কাকলি হালকা হেসে বলে- তখন তো আমাদের বয়স হয় নি।

ইমাম দৃঢ় কন্ঠে বলল- বয়স হয় নি তাতে কী? প্রেম তো বছরের পর বছর ধরেও বেঁচে থাকতে পারে।

রাতের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। জানালার বাইরে পাহাড়ের ঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ একবার কাকের ডাক ভেসে আসে। ঘরের ভেতর আলো-আঁধারি। ঠিক তখনই কাকলি হেসে ইমামকে প্রশ্ন করল-

“শোনো, কাকেরা সাবান চুরি করে কেন, তুমি জানো?”

ইমাম চমকে তাকাল। প্রশ্নটা হালকা, অথচ ভেতরে যেন লুকিয়ে আছে কোনো রহস্য।
“না,” সে ধীরস্বরে বলল, “আমি ভাবতাম ওরা শুধু খাবার চুরি করে। কিন্তু সেদিন বুঝলাম, কাক কেবল নিজের আনন্দের জন্যও চুরি করতে পারে। আর সেই চুরি কখনো কখনো মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনে। অনেকটা ভাগ্যের মতো- অপ্রত্যাশিত, অদৃশ্য। যেমনটা ঘটেছিল সেইদিন আমার ও তোমার বেলায়।”

কাকলির চোখে ভেসে উঠল ঝলমলে এক রহস্যময় আলো। সে মৃদু হেসে বলল-
“হ্যাঁ, প্রতিটি ঘটনার ভেতরেই কোনো না কোনো শিক্ষা লুকানো থাকে। কেবল হৃদয় খুলে সেই শিক্ষা খুঁজে নিতে হয়।”

ঘরের বাতাস তখন ভারী। নীরবতার ভেতরে বাজতে থাকে অদৃশ্য সুর- স্মৃতির, লজ্জার, আকাঙ্ক্ষার আর দীর্ঘ প্রতীক্ষার। তাদের অতীত আর বর্তমান এক অদ্ভুত স্রোতে মিশে গেল।

ইমাম হঠাৎ গভীর স্বরে বলল-
“মনে হয়, কাকেরা টিভির বিজ্ঞাপন দেখে ভেবেছিল, সাবান মাখলেই কালো থেকে ফর্সা হবে। যেন তাদের কালো ডানায় আলো ফুটে উঠবে। কিন্তু পরে বুঝল, এ সবই বিজ্ঞাপনের ভেলকি। যতই সাবান মাখুক, কাক কাকই থাকবে- কালো চোখ, কালো ডানা। সাদা হওয়ার গল্প শুধু প্রতারণা। তাই সাবানচুরি বন্ধ করেছে তারা। তবে যদি আবার ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে, কে জানে- আবার নতুন প্রলোভনে পড়ে কিনা!”

কাকলি হালকা হাসল। সেই হাসিতে ছিল ব্যঙ্গ, ছিল সত্যের দীপ্তি।
“ফেয়ার এন্ড লাভলী?” সে বলল, “ওটা তো কেউ পুকুরঘাটে ফেলে রাখে না, সাজঘরে ড্রেসিং টেবিলে থাকে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সাবানের মতো এটাও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। কালোকে সাদা করতে পারে না, পারে শুধু ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। এতে ক্যান্সারের ঝুঁকি পর্যন্ত আছে। মানুষের জন্যই এটা ভয়াবহ, কাকের জন্য তো আরও মারাত্মক।”

ঘর আবার নীরব হয়ে গেল। শুধু বাইরে কাকের ডাক ভেসে আসছিল, যেন তারাও স্বীকার করছে-
ভুল ভরসার পেছনে ছুটে কখনো মুক্তি মেলে না।

কাকের সাবানচুরি তাই শুধু একটি কৌতুক নয়- এ এক আয়না, যেখানে মানুষ নিজের ভ্রান্ত বিশ্বাস আর অন্ধ প্রলোভনকেই দেখতে পায়।

কাকলির চোখে কৌতূহল দেখা দিল।

ইমাম আবার বলতে লাগল-
“দেখো, অনেক মানুষ এখনো সুন্দর হওয়ার আশায় এসব সাবান বা ফেয়ার এন্ড লাভলী ব্যবহার করে। কিন্তু সত্যিটা হলো, এগুলো কারো চামড়ার রং পরিবর্তন করে না। জন্মের সময় যে রঙ নিয়ে মানুষ আসে, সেটাই তার আসল পরিচয়। সাবান কেবল ময়লা দূর করে, এর বেশি কিছু নয়। কাকরা হয়তো আগেই বুঝে গেছে বিজ্ঞাপনের ভেলকি। তাই আজকাল আর সাবান চুরি করে না।”

কাকলির চোখে কৌতূহল জমল। সে চুপচাপ শুনছিল। ইমাম আরও বলল-
“তবে কখনো যদি কাককে চুরি করতে দেখা যায়, সেটা খুবই বিরল। আগেকার সাবানে পশুর চর্বি ব্যবহার করা হতো- সে কারণেই কাক আকৃষ্ট হতো। এখন প্রযুক্তির উন্নতিতে সেই জায়গায় কেমিক্যাল এসেছে। ফলে কাকের আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। আর তুমি হয়তো খেয়াল করছ না, কারণ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে তুমি ব্যস্ততায় ডুবে গেছ। সেই অবসরের দিনগুলো আর নেই, যখন কাকের ছোট্ট চুরি দেখার মতো সময় ছিল।”

কাকলি হেসে বলল-
“ওহ! তাহলে বুঝছি তোমার দিনগুলো কেটেছে কাকের পেছনে ছুটে?”

ইমাম মাথা নুইয়ে হেসে উত্তর দিল-
“হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়। কিন্তু ভাবো তো, সেই ছোট্ট কাকের ঘটনাতেই আমাদের জীবনের বড়ো শিক্ষা লুকিয়ে আছে- মানুষের তাড়াহুড়া, বিজ্ঞাপনের মিথ্যা প্রলোভন, আর প্রকৃত সৌন্দর্যের মূল্য।”

ঘরে তখন নিস্তব্ধতা। সেই নীরবতা যেন তাদের ভেতরের ভাবনাগুলোকে হৃদয়ের গভীরে জমিয়ে রাখছিল। কাকের ছোট্ট চুরি থেকে শুরু হয়ে মানুষের বড়ো ভুল- সব মিলিয়ে তাদের মনে জন্ম নিচ্ছিল এক মধুর উপলব্ধি।

হঠাৎ দূরে কোথাও একঝাঁক কাক ডাকল। শব্দটা যেন নিছক কাকের ডাক নয়- বরং অতীতের সব স্মৃতি, সব প্রলোভন আর সব সত্যকে মনে করিয়ে দিল। এক মুহূর্তে ইমামের মন ডুবে গেল অব্যক্ত চিন্তায়।

ঠিক তখনই আযানের সুমধুর সুর ভেসে এলো-
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।”

শব্দটি যেন তাদের সমস্ত চিন্তাকে ছাপিয়ে দিল। কাকের কোলাহল, বিজ্ঞাপনের ভেলকি, জীবনের শিক্ষা- সব পেছনে পড়ে গেল। শরীর ও মন একযোগে সেই আহ্বানে সাড়া দিল। তারা দু’জনই নীরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল নামাজের জন্য।

ঠিক তখনই আযানের সুমধুর সুর ভেসে এলো-
“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।”

শব্দটি যেন তাদের সমস্ত চিন্তাকে ছাপিয়ে দিল। কাকের কোলাহল, বিজ্ঞাপনের ভেলকি, জীবনের শিক্ষা- সব পেছনে পড়ে গেল। শরীর ও মন একযোগে সেই আহ্বানে সাড়া দিল। তারা দু’জনই নীরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল নামাজের জন্য।

রাতটা যেন বাসর ঘরের আবেশেও কাকের স্মৃতির ছায়া নিয়ে বয়ে চলেছে। প্রতীক্ষার দীর্ঘ রাত্রি, আগের দিনের কাকের গল্প, অদৃশ্য আবেগ- সব মিলেমিশে ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত মায়ার তরঙ্গ তুলছে।

কাকলি ইমামের বুকের ওপর মাথা রেখে নিশ্চুপ শুয়ে আছে। ডিম আলোর মোলায়েম আভা তার মুখে এক অদৃশ্য দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছে। সহপাঠিনী হলেও বয়সে হয়তো দু’বছরের ছোট সে, কিন্তু তার মানসিকতার পরিণত সৌন্দর্য ইমামকে নিঃশব্দে মোহিত করে চলেছে।

ইমাম ধীরে ধীরে কাকলির এলোমেলো চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিল, তারপর পরম মমতায় তার কপালে রাখল এক মোলায়েম চুম্বন। সেই ক্ষণেই তার মনে হলো- প্রিয় মানুষটিকে এভাবে বুকে আগলে রাখার ভেতরেই লুকিয়ে আছে জীবনের সমস্ত সুখ, প্রশান্তি আর নিবিড় শান্তির পূর্ণতা। বাসর ঘরের নাটকের পর্দা যেন নিজে থেকেই নেমে এলো- চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারকে ঢেকে দিল নরম আলোয়, আর নিস্তব্ধতাকে রূপ দিল এক সুরেলা শান্তিতে।

তবুও জীবন কেবল আবেগে ভেসে থাকা নয়, দায়িত্বের ডাক অগ্রাহ্য করা যায় না। তাই কাকলিকে কোমলভাবে বাহুডোরে জড়িয়ে রেখে ইমাম নিঃশব্দে খাট থেকে নামল, অত্যন্ত সাবধানে দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে গেল। মসজিদের মিনার তখন আকাশে দাঁড়িয়ে আছে চিরন্তন প্রহরীর মতো, ভোরের আগমনী বার্তা নিয়ে। সে রওনা হলো ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে।

নামাজের মধুর আলোয় তার শরীর ও মন ক্রমে এক গভীর প্রশান্তিতে ভরে উঠল। কাকের ডাকের পুরনো স্মৃতি, দিনের ক্লান্তি, আর বাসর ঘরের উচ্ছ্বাস- সব মিলেমিশে যেন এক অদ্ভুত স্মৃতির জাল বুনে চলল মনে। রাত তখনও শেষ হয়নি, অথচ তার ভেতরেই যেন নতুন এক ভোরের শুভ সূচনা হচ্ছে।

ইমামের মনে তখন কেবল একটিই উপলব্ধি- জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, যদি ভালোবাসা আর দায়িত্ব একসাথে হাতে হাত রেখে চলে, তবে সেখানেই লুকিয়ে আছে সত্যিকার শান্তি, সত্যিকারের আনন্দ এবং পরিপূর্ণ জীবনের সার্থকতা।

সমাপ্ত