কক্সবাজারের আকাশ আজ সকাল থেকে ছিল কাঁচের মতো স্বচ্ছ। বিকেলের রোদ সবুজ পাহাড়ের গায়ে লেপটে আছে। লাবনী পয়েন্টে একটি ফোর-স্টার হোটেলের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে আছে একটি কালো প্রাডো গাড়ি। গাড়ি থেকে নামল দু’জন। একজন লম্বাটে শ্যামলা তরুণী, গায়ে হালকা নীল রঙের গাউন, চুলগুলো তেলতেলে। স্বভাবে সে ছিল খুবই চঞ্চল, বাকপটু ও সহসী। নাম তার ফারজানা আকতার সিথী। আরেকজন খাটো কিন্তু আকর্ষণীয়, চোখে সানগ্লাস, নাম তার শান্ত মাহমুদ।
সিথী নোয়াখালীর এক প্রাইভেট হাসপাতালের নার্স, প্রথমবারের মতো সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছেন প্রেমিকের সঙ্গে। দু’জনের পরিচয় অনেক আগেই, ফেসবুকে। প্রথমে ছবিতে লাইক-কমেন্ট, ইনবক্সে চ্যাটিং, তারপর রাতভর অডিও-ভিডিও কল। কথা বলতে বলতে রাত গড়াত, তারপর শেষরাতে ঘুম। সেই আড্ডার মাঝে শান্ত’র মেকি ভালবাসায় সিথীকে আরো কাছে নিয়ে যায়। একসময় পাঠাতে থাকে অদ্ভুত সব ভিডিও, পর্নোছবির ক্লিপ, নগ্ন ফটো। শুরুতে রাগে গরম হয়ে যেতো সিথী। এরপর এক অদৃশ্য কৌতূহল ও প্রেমিককে বিয়ে করে আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন যেন তাঁকে শান্তর প্রতি অনেকটা অস্বাভাবিক দুর্বল করে দেয়। সুযোগটা কাজে লাগায় শান্ত। ভিডিও কলে মাথায় হাত রেখে প্রতিশ্রুতি দেয় সে, শিগরিই বিয়ে করবেন তারা। কখনও একে অন্যকে ছেড়ে যাবে না। বিয়ের পর আমেরিকা ফিরে যাওয়ার সময় সিথীর পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে যাবে বলে জানায়। তার আগে শর্ত দেয় চতুর শান্ত। পরশু দিন সিথীকে নিয়ে দু’দিনের জন্য কক্সবাজার বেড়াতে যাবে। সেখানে তারা স্বামী-স্ত্রী’র পরিচয়ে হোটেলে থাকবে এবং একসাথে রাত কাটাবে। একদম হানিমুন বলা যায়।
আমতা আমতা করছিল সিথী। এটা কিভাবে সম্ভব! চতুর শান্ত সিথীকে অনেক স্বপ্ন দেখায়। একমাস লেগে থেকে একসময় বুঝিয়ে সন্মতি আদায় করে নেয় শান্ত।
কক্সবাজার হোটেলে ঢুকেই কিছুক্ষণ পর গাড়ি নিয়ে দু’জন সরাসরি চলে গেলেন লবনী সী-বিচের একদম উত্তর পাশে জনমানব শূণ্য একটি পয়েন্টে। নীল পানির উপর ছিটকে পড়া বিকালের রোদ যেন কাচের টুকরো। সিথী স্বল্পবসনা, স্লিম ফিগার, লম্বা দেহে জলকেলিতে মগ্ন। হাসির শব্দ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। শান্ত মোবাইলে বারবার সিথীর ছবি তুলছে, আর এসএলআর ক্যামরাটি স্ট্যান্ডে লাগিয়ে অটো ভিডিও করছে। কখনও সেলফি, কখনও তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ক্লোজ শট নিচ্ছে।
সিথী দু’চোখ থেকে পানির ফোঁটা মুছে ভ্রু কুঁচকে ধমকের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই, তুমি এতো ছবি-ভিডিওর পাগল কেন?’
শান্ত থতমত খেয়ে নরম গলায় বলল, ‘তোমার সঙ্গে যতটা পারি ক্যাপচার করে রাখতে চাই। যখন পাশে থাকবে না, তখন এগুলো দেখবো।‘
কিন্তু শুধু সী-বিচে নয়, ওইদিন ডুবন্ত বিকালে পাহাড়ি রাস্তা, ডিসি হিল, সব জায়গায়ই শান্তর হাতে মোবাইল বা ক্যামেরা। সিথী ভাবেন, এটা হয়তো প্রেমিকের মিষ্টি পাগলামি। জানতেন না, সেই ভালোবাসার আড়ালে গড়ে উঠছে এক অদৃশ্য ফাঁদ।
হোটেলের দ্বিতীয় রাতের কথা সিথী কোনোদিন ভুলতে পারবে না। সেদিন সে ভেবেছিল, তারা দু’জন একান্তে থাকবে। কিন্তু শান্ত যেন ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিল। কক্ষের আলো ম্লান, জানালার পর্দা টানা, স্ট্যান্ডে রাখা ক্যামেরা স্থিরভাবে তাক করা। সিথী ভাবলেন, ফ্লাশ ছাড়া ছবি হয় না, ভিডিও করতে হলেও ক্যামরা হাতে নিয়ে মুভ করতে হয়। ক্যামরা হয়তো শান্ত এমনিতেই রেখেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই শুরু হলো গোপনে ভিডিও ধারণ, এমন সব দৃশ্য ধারণ, যা পর্নোছবির মতই স্পষ্ট, খোলামেলা। যা সিথী একদম ভাবতেও পারেনি।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল, পরবর্তীতে জানতে পেরেছে এই ভিডিওগুলোর বেশিরভাগই ধারণ হয়েছিল গোপন ক্যামেরায়।
সিথী তখনও বুঝতে পারছিল না, তাদের সম্পর্কের ছায়ায় কতটা বিপদ জমে উঠছে। তাঁর কাছে শান্ত ছিল ঢাকা শহরের একটি ধনী পরিবারের সন্তান, গাড়ি ব্যবসায়ী, ও আমেরিকা প্রবাসী যিনি ব্যস্ততার মাঝেও বেড়ানোর জন্য সময় দিয়েছেন এবং নিজের গাড়ি নিয়ে নোয়াখালী এসে তাকে সঙ্গী করে কক্সবাজার নিয়ে এসেছেন। তিনি ভাবতেন, এই মানুষই হয়তো তার স্থায়ী ঠিকানা হবে। কিন্তু সেই সফরের কয়েক সপ্তাহ পর, সবকিছু পাল্টে যায়…
শান্ত সিথীকে মাইজদী শহরে নামিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফিরে যায়। কয়েকদিন সবকিছু স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। ভ্রমণ শেষে গত পাঁচ দিন ধরে সিথী ডিউটিতে ব্যস্ত সময় পার করছে।, রোগীর সেবা করছে, জুনিয়র নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের ডিউটি পরিদর্শন করছে। মাঝেমধ্যে নিজের কক্ষে চুপিসারে শান্তর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। আজ শান্ত ওপাশ থেকে তাদের কক্সবাজার ভ্রমণের বেশ কয়েকটি স্থির ছবি পাঠায়। অধিকাংশ ছবিই স্বল্পবসনা ও জলকেলির। অল্প কিছু ছবি স্বাভাবিক। সিথী ছবিগুলো দেখে হাসলো।
শান্তকে কল দিয়ে বলে, ‘’প্রিয়, ছবিগুলো খুবই সুন্দর হয়েছে। এজন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
শান্ত জবাব দেয়, ‘’সুন্দর তো হবেই, ক্যামরাটা আমেরিকা থেকে কেনা হয়েছে। খুবই দামী ও মাল্টিফাংশনাল।
-ছবি দেখে সেটাই তো বুঝা যাচ্ছে।
-তোমার কাছে আমি ১০টা ছবি পাঠিয়েছি, শত শত ছবি এখনো আমার ক্যামরায়।
-এত ছবি কখন তুলেছো? দেখলাম যেন ১০ থেকে ১২টা ছবি তুললে। অন্য ছবিগুলো জ্বীনে এসে তুলে দিয়েছে নাকি?
-জ্বীন আসবে কেন? আমার ক্যামরায় প্রতিটা ক্লিকে এক সেকেন্ডে ১৫টা ছবি উঠে যায়।
-তাই! এটা তো জানতাম না।
-শুধু কি তাই? একই সাথে অন্য লেন্স দিয়ে ভিডিও করা যায়।
-তোমাকে বলেছিলাম না বিশ্রি ছবি না তুলতে?
-তোমার ছবিগুলো তুলে আমি বেশ মজা পেয়েছি, যখন তুমি পাশে থাকবে না তখন ছবিগুলো দেখবো।
-তোমার কাছে আমি হাতজোড় অনুরোধ করছি, ‘’তুমি বিশ্রি ছবিগুলো সংরক্ষণ ফাইল থেকে ডিলেট করে দাও।
-আচ্ছা দেবনি। তোমার সামনেই ডিলেট করবো, নচেৎ তোমার বিশ্বাস হবে না।
-আমি তো নোয়াখালীতে।
-তুমি কাল ঢাকায় আস, রাতে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান। এ দিনে আমি তোমাকে পাশে চাই।
-তা কিভাবে সম্ভব? আমি জব করছি তো।
-সেটা আমি জানি। তোমার জব করার প্রয়োজন নেই। তোমাকে তো দ্রুত আমেরিকায় নিয়ে আসছি।
-আচ্ছা ঠিক আছে, ভাববো কাল ঢাকায় যাওয়া যাবে কি না।
-ভাবতে হবে না। তোমার ভালবাসার মানুষটির জন্মদিন অথচ তুমি থাকবে না, এটা কী হয়?
-আচ্ছা দেখি কী করা যায়।
-তুমি না আসলে কাল তাহলে আমি জন্মদিন পালনই করবো না।
-এমন কঠিন সিদ্ধান্ত যখন নিতে পারলে তাহলে কাল আমি আসবো। ঠিক আছে , এখন রাখি। বসকে জানাতে হবে।
-ওকে, ধন্যবাদ তোমাকে।
শুরু থেকে শান্ত বারবার ফোন করে কখনো মিষ্টি কথা, কখনো অতি ভালবাসা আর কখনো আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে এবং সর্বশেষ তার জন্মদিনের আমন্ত্রণ জানিয়ে সিথীকে সম্পূর্ণ নিজের কব্জায় নিয়ে আসে।
পরদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছাল সিথী। রাত তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। শান্ত নিজেই গাড়ি নিয়ে আরামবাগ এসে সিথীকে বাস থেকে রিসিভ করে খিলগাঁও নিয়ে যায়।
শান্তর বাসা ছিল গোরান একটি অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে। তৃতীয় তলায় দরজায় ঢুকতেই দেখা গেলো রঙিন বেলুন, আলো, আর মৃদু সঙ্গীত, সবই জন্মদিনের আমেজে সাজানো। কিন্তু সিথীর চোখে পড়লো, এখানে অন্য কেউ নেই, শুধু তারা দু’জন।
— ‘বাকি অতিথিরা?’ সিথী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
— ‘আমাদের জন্য আলাদা উদযাপন।‘ শান্ত হাসলো।
সেই হাসির পেছনে ছিল এক অদ্ভুত তৃপ্তি, যা সিথী আগে কখনো টের পায়নি।
কেক কাটার পর শান্ত ধীরে ধীরে ফ্রিজ থেকে ওয়াইন বের করলো।
সিথী আপত্তি জানালেও শান্ত বললো, ‘একটু খেলে কিছু হবে না, আমেরিকায় গেলে তো এসব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।‘
ওই রাতের প্রায় সব মুহূর্ত শান্ত নিজের সিসি ক্যামেরা ও ল্যাপটপ দিয়ে ধারণ করছিলো। সিথী প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু ভোরের আগে একবার বাথরুমে গিয়ে ফিরে আসার পর দেখলো, শান্ত ল্যাপটপে কিছু ফুটেজ এডিট করছে, আর তার মুখে রহস্যময় হাসি।
সিথী জানতে চাইলো, কক্সবাজারের বিশ্রী ছবিগুলো ডিলেট কর, আমি কিছুক্ষণ পর নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দেব।
-ছবিগুলো তুমি আসার আগেই ডিলেট করেছি। তুমি চাইলে আমার মোবাইল ও এসএলআর ক্যামরা চেক করতে পার।
-সত্যি বলছো?
-আমি কখনো মিথ্যা বলি না। কসম দিয়ে বলছি -ছবিগুলো তুমি আসার আগেই ডিলেট করেছি।
-বিশ্বাস করলাম। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে বলেই তো সব সময় তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছি।
শান্ত সকালের গোসল সারতে ওয়াশরুমে ঢুকেছে। মোবাইলের রিংটোন বারবার বাজছে। কক্সবাজারে থাকাকালীনও এমন কয়েকবার এসেছিল, কিন্তু শান্ত তখন কল কেটে দিয়েছিল। আজও প্রথম তিনবার কেটে দিল, চতুর্থবার ধরে হঠাৎ কর্কশ গলায় বললো, ‘অযথা বারবার কল দিচ্ছ কেন? জানো না, এ সময়ে আমি ঘুমাই?’
ওপাশ থেকে কিছু শোনে শান্ত আবার বললো, ‘তুমি পরশু চলে আসো। আর বেড়ানো ঠিক হবে না, রান্নাবান্নায় সমস্যা হচ্ছে।‘
কল কেটে সে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই আবার ফোন বাজল রিং… রিং… কিন্তু এবার মিসড কল হয়ে গেল। ত্রিশ সেকেন্ড পর আবারও রিং। কৌতূহল সামলাতে না পেরে সিথী ফোনটি রিসিভ করল। ওপাশে এক তরুণীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ
-‘শান্ত কোথায়?’
সিথী একটু থেমে বলল, ‘ওয়াশরুমে। দশ মিনিট পরে কল দিন। আপনি কে বলছেন?’
ওপাশ থেকে চড়াকণ্ঠে ধমক, ‘আগে তোমার পরিচয় বল। তুমি কে?’
সিথী সরল স্বরে, ‘আমি শান্তর মেহমান।‘
ওপাশের শব্দ যেন সুঁই হয়ে বিধেঁ গেল কানে।
— ‘তুই আমার সংসার ভাঙতে এসেছিস, মাগি কোথাকার!’
সিথীর বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল। হাত কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। কল কেটে সিঁড়ি বেয়ে দৌঁড়ে নেমে এলো নিচে। তার মোবাইল অফ করে নেয়। বাইরে বেরিয়ে রাস্তার কোণে দাঁড়ানো সিএনজিতে উঠে চালককে বলল, ‘সাইনবোর্ড লালসবুজ কাউন্টার।‘
চালক ভ্রু কুচকে বললো, ‘ম্যাডাম কাছেই তো কাউন্টার আছে, এত দূরে।‘
-ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। যা বলছি তাই করেন। মিটারের রিডিং থেকে আরো একশ টাকা বেশি দেব।
-ঠিক আছে ম্যাডাম, উঠুন।
ঢাকার অফিস টাইম। চারপাশে গাড়ির দীর্ঘশ্বাসে জমে থাকা জ্যাম, মাথার ওপরে কড়া রোদ, সিএনজির ছাদ থেকে নেমে আসা ভেসপা গরম আর নিজের মাথায় জমে থাকা মানসিক অস্বস্তি সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, প্রাণটা ধীরে ধীরে অবসাদের কুয়ায় ডুবে যাচ্ছে।
সিথী ঢাকার শহরের কোনো কাউন্টারে না গিয়ে দূরের চিটাগং রোডের কাউন্টার বেছে নিল । শান্তর হাত থেকে অন্তত কিছুটা নিরাপদ মনে হয় সেখানে। একা ডি-১ আর ডি-২—পাশাপাশি দুই সিটের টিকিট কিনে পাশের হোটেলে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল।
বাস ছাড়তেই সে সিটে বসে চোখ বুজল। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন। শান্ত এমন প্রতারণা করল কেন? বউ আছে সেটাএতদিন লুকিয়ে রাখল কেন? আমার তো সব শেষ করে দিল। আমার মান-সম্মান, ইজ্জত—সবই হারালাম।
তবুও এক মুহূর্তে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা। হয়তো বড়লোকরা এমনই করে, দু’টো সংসার চালায়। তাছাড়া শান্ত তো আমেরিকান প্রবাসী, ওর কাছে এটা অপরাধ নয় হয়তো।
বাস কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি দিলে সিথী ফোন চালু করল। মুহূর্তেই ‘টিং টিং’ করে একের পর এক বার্তা জমা হতে লাগল। প্রথমেই ম্যাসেঞ্জার খুলে দেখল শান্তর ম্যাসেজ।
— ‘তোমার ছবি আর ভিডিওগুলো আমার কাছে কোনো স্মৃতি নয়, বরং তোমাকে নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র।‘
তারপর এল একটি ভিডিও, সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে সিথী জলকেলিতে, পাতলা থ্রিপিস ভিজে শরীরে লেপ্টে আছে… সবকিছু স্পষ্ট।
ভিডিওটা দেখা শেষ হতেই সিথীর পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। আঙুলে শক্তি নেই, মনে হচ্ছে ফোনটাই হাত থেকে পড়ে যাবে। বুকের ভেতরে অদ্ভুত শূন্যতা, গলার কাছে কাঁটার মতো আটকে থাকা লজ্জা আর রাগ মিশ্রিত এক অনুভূতি।
বাসের জানালা দিয়ে দূরের দৃশ্য দেখতে দেখতে তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘এই শান্ত আসলে কে? সত্যিই কি সে আমেরিকান প্রবাসী? নাকি আমাকেই বোকা বানানোর জন্য এসব গল্প?’
চোখের সামনে ভেসে উঠছে শান্তর মায়াবী হাসি, তার দামি ক্যামেরা, সুগন্ধী প্রসাধনী, আভিজাত্যের ভঙ্গি, আর সেই বারবার শোনা আমেরিকার গল্প – যা এখন সবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।
সিথী নোয়াখালী পৌঁছে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিল, ‘যে করেই হোক শান্তর আসল পরিচয় জানতে হবে।‘
সে নোয়াখালীর এক পুরনো সহপাঠী রুবেলকে ফোন দিল। রুবেল ঢাকায় সাংবাদিকতা করে। ফোন ধরতেই সিথী সরাসরি বললো,
– ‘রুবেল, তোর একটু সাহায্য দরকার। শান্ত নামের একজন লোক আমার ফেসবুকে যুক্ত আছে, সে এখন ঢাকায় খিলগাঁও থাকে। পুরো নাম শান্ত মাহমুদ। সে বলে আমেরিকায় থাকে। ঢাকায় বনশ্রীতে একটা বাড়ি ও গোরানে একটা ফ্ল্যাট আছে, কিন্তু আমি জানতে চাই আসলেই ও কেমন মানুষ।‘
রুবেল প্রশ্ন করলো, ‘তুই বিপদে পড়েছিস নাকি?’
– ‘পরে বলবো। আগে খোঁজটা নিয়ে দে, তার মোবাইল নং……….।‘
রুবেল পরদিনই খবর দিল,
– ‘দেখ, শান্ত মাহমুদ নামে আমেরিকার কোনো ঠিকানায় রেকর্ড পাইনি। তবে ঢাকার বনশ্রীর ঠিকানায় শান্তুর নামে ফ্ল্যাট আছে। সে খিলগাঁও ভাড়া বাসায় থাকে এবং ওই বাসায় ওর স্ত্রী-সন্তান থাকে। লোকটা এখানে-সেখানে ব্যবসার নাম করে ঘোরে, ভারত ও থাইল্যান্ডে যাওয়া-আসা করে। কিছু বিদেশি ফটোগ্রাফারের সাথে যোগাযোগ আছে, তাই হয়তো বিদেশি সাজে।‘
সিথীর বুকের ভেতর হঠাৎ করেই একটা হাহাকার উঠল, তাহলে সবই মিথ্যা! সে শুধু বউয়ের কথাই লুকোয়নি, আমেরিকার গল্পটাও বানানো !
রাতের বেলা বাসায় বসে সিথী শান্তর দেওয়া ছবিগুলো আবার দেখতে লাগল। প্রতিটা হাসি, প্রতিটা কথা এখন বিষের মতো মনে হচ্ছে। ফোন হাতে নিয়েও সে শান্তকে আর কল করল না। জানে, শান্ত কথা ঘুরিয়ে আবার মায়াজালে ফেলতে চাইবে।
বরং তার মাথায় এখন আরেকটা চিন্তা ঘুরছে, এই লোকটার আসল চেহারা সবার সামনে আনতে হবে।
সিথী জানে, শুধু সন্দেহ দিয়ে শান্তকে হারানো যাবে না। তার বিরুদ্ধে কথা বললে অনেকে উল্টো তাকে দোষারোপ করবে।
তাই প্রথমে প্রমাণ দরকার, মজবুত, অস্বীকার করার সুযোগ নেই এমন প্রমাণ।
রাত গভীর হলে সে রুবেলকে আবার ফোন করল।
-‘তুই কি শান্তর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম সব ঘেঁটে দেখতে পারবি? হয়তো পুরনো কোনো ছবি বা পোস্টে ওর আসল চেহারা ধরা পড়বে।‘
রুবেল পরদিন কয়েকটা স্ক্রিনশট পাঠাল।
প্রথম স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, শান্ত পাঁচ বছর আগে এক নারীর সঙ্গে কক্সবাজারে। মন্তব্যে অনেকে লিখেছে, ‘ভাবির সঙ্গে খুব সুন্দর লাগছে।‘
দ্বিতীয় স্ক্রিনশটে শান্ত ও এক নারীর একটি জন্মদিনের কেক কাটছে, টেবিলে এক শিশুও আছে। ক্যাপশন, ‘আমাদের ছোট্ট রাজকন্যার জন্মদিন।‘
সিথীর হাত কাঁপতে লাগল। এই ছবিগুলো শান্তর , আমেরিকান অবিবাহিত পরিচয়ের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিল।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। রুবেল জানাল,
– ‘শান্তর নামে আরও কিছু কানাঘুষা আছে। শুনেছি ও আগে এক প্রাইভেট কোম্পানির রিসেপশনিস্ট মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করত। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা চাকরি ছেড়ে অন্য শহরে চলে যায়। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকেও সে ফাঁসিয়েছিল কিন্তু সেই মেয়ে নাকি ভয় পেয়ে মুখ খোলেনি।‘
সিথী সিদ্ধান্ত নিল, এই নারীদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রথমে রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে খুঁজে পায় রুবেলের মাধ্যমে। মেয়েটি প্রথমে কথা বলতে দ্বিধা করলেও পরে ধীরে ধীরে খুলে বললো—
‘শান্ত আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কক্সবাজারে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানেই ছবি ও ভিডিও তুলেছিল। পরে যখন আমি চাপ দিই, ও বলল, ‘এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়ে গেলে তোর জীবনে আগুন লেগে যাবে। আমি ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যাই।‘
দ্বিতীয় শিকারকে সিথী খুঁজে পায় ফেসবুকের মাধ্যমে। সে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, এখন বিয়ে হয়ে গেছে। সে জানায়, শান্ত শুধু মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয়ই করেনি, বরং এক সময় টাকা ধার নিয়ে ফেরত দেয়নি। ফেরত চাইলে ছবি ও ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখাত।
এখন সিথীর হাতে শুধু নিজের নয়, আরও দুই নারীর সাক্ষ্য, স্ক্রিনশট, ছবি আর শান্তর পুরনো ফেসবুক পোস্ট, সব মিলিয়ে শক্ত প্রমাণ হাতে এসেছে।
সেদিন রাতে বাসায় ছোট্ট টেবিলে এসব প্রমাণ সাজিয়ে রেখে সিথী আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাল। চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, ‘এবার পালানোর সুযোগ পাবে না শান্ত মাহমুদ।‘
এ সময় শান্তর ফোন, ‘’তুমি আমার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করার চেষ্টা করলে তোমার ছবি ও ভিডিওগুলো হয়তো খারাপ মানুষের হাতে চলে যেতে পারে।‘
সিথীর হাত কাঁপছিলো। বুঝতে পারলো, কক্সবাজার ভ্রমণ ছিল শুধু ভালোবাসার ভ্রমণ নয়, বরং এক সুপরিকল্পিত ফাঁদ।
এদিকে মাইজদীতে তার ডিউটি স্বাভাবিকভাবে চলছে বটে, কিন্তু মনের মধ্যে ভয়ের ছায়া ক্রমেই ঘন হচ্ছে। হাসপাতালের করিডোরেও যেন মাঝে মাঝে অচেনা দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে।
ঠিক তখনই শান্ত মোবাইলে বললো, ‘তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাও, আমি কিন্তু সব ছবি আর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেবো।‘
সিথীর গা আবারও আতঙ্কে শিউরে উঠলো। বুঝতে পারলো, এই সম্পর্ক এখন কেবল ভালোবাসার নয় বরং এক নির্মম ব্ল্যাকমেলের দখলে।
পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ শান্ত প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাতে থাকে। কখনো পুরনো ছবি, কখনো ভিডিও ক্লিপ, আর সঙ্গে হুমকি-
‘আমার কথা না শুনলে, কাল সকালেই তোমার ছবি ভাইরাল হবে।‘
সিথী ভেঙে পড়লেও চুপ ছিল। কিন্তু একদিন হঠাৎ তার অফিসের কম্পিউটারে একটি ইমেইল আসে। প্রেরক অচেনা, তাতে অ্যাটাচ করা আছে তার ব্যক্তিগত ছবি। বুঝতে বাকি থাকলো না, শান্ত শুধু নিজেই ছবি রাখেনি, অন্য কারও সাথেও শেয়ার করেছে।
এই অবস্থায় সিথী গোপনে নোয়াখালী পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাথে যোগাযোগ করে। তারা সিথীর মোবাইল নম্বর, শান্তর বিস্তারিত তথ্য লিখে নিয়ে সিথীকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়।
নোয়াখালী পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট শান্তর বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি ঘেটে বুঝতে পারে শান্ত শুধু সিথীর সাথেই নয়, অন্তত আরও চারজন নারীর সাথে একই কায়দায় প্রতারণা করেছে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ছবি ও ভিডিও ছিল ব্ল্যাকমেলের অস্ত্র। ক্রাইম ইউনিটের একজন অফিসার সিথীকে ফোন করে জানায়, যথেষ্ট প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। আপনি দ্রুত থানায় গিয়ে অভিযোগ দেন।
আজকেও সিথীর মেইলে একটা লিংক এলো। সিথী দ্বিধায় পড়ে লিঙ্কে ক্লিক করলেন। পরের কয়েক সেকেন্ড তাঁর বুকের ভেতর থেকে যেন রক্ত শুকিয়ে গেল, এটা সেই খিলগাঁও বাসায় গোপনে ধারণ করা ভিডিও! স্পষ্ট, নির্লজ্জ, ভিডিও জুড়ে সে আর শান্ত।
হাত কাঁপতে কাঁপতে মোবাইল থেকে কল দেয় শান্তকে।
— ‘এগুলো এখানে কে দিল? তুমি দিয়েছ?’
শান্তর গলা ঠান্ডা, প্রায় নিরাসক্ত। বললো , ‘শান্ত হও। কারো হাতে চলে গেছে হয়তো। আমি দেখছি।‘
তবে “দেখছি’’ মানে আসলে কী, তা বুঝতে সিথীর সময় লাগেনি। পরের দিন শান্ত নিজেই ফোন করে বলল,
– ‘শোনো, তোমার ইজ্জত রক্ষা করতে চাইলে এ ছেলেদেরকে খুশি করতে হবে। না হলে এগুলো থামানো মুশকিল হবে।‘
সিথীর প্রশ্ন, ‘’কী করতে হবে আমাকে?’
-তোমাকে এ মুহূর্তে পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে।
সিথী বাকরুদ্ধ। এ কি সেই প্রেমিক, যিনি বলতেন, ‘তুমি আমার জীবনের সেরা উপহার?’
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পরের কয়েকদিনে অচেনা নাম্বার থেকে অশ্লীল ম্যাসেজ, ব্ল্যাকমেইলের হুমকি, আর এক অদ্ভুত ভীতি তাকে ঘিরে ধরল। সে রাতে ঘুমাতে পারত না, ডিউটিতে মন বসত না।
সাংবাদিক রুবেলের পরামর্শে অবশেষে এক বিকেলে সব সাহস জোগাড় করে, সিথী চলে গেল সুধারাম থানায়। অভিযোগ দিলেন, সমস্ত ঘটনা মুখেও খুলে বলল, ‘ওই ভিডিও, ছবি সব তার ফোনে আছে। এমনকি তার অজান্তে গোপন ক্যামেরায় তোলা… দয়া করে কিছু করেন স্যার।‘
থানার ওসির চোখেমুখে তখন অপরাধীকে পাকড়াও করার দৃঢ়তা। ওসি বলল, ‘ঠিক আছে মা। আমরা দেখছি । ওকে ধরবো।‘
পরের সপ্তাহে পুলিশের একটি টিম ঢাকায় গিয়ে খিলগাঁও থানার সহযোগিতায় শান্তকে গ্রেপ্তার করে নোয়াখালী নিয়ে আসে। গ্রেপ্তারের সময় তার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হলো শত শত ছবি, দুইটি হার্ডড্রাইভ, একটি এসএলআর ক্যামরা, চারটি মোবাইলসহ সেই কুখ্যাত ভিডিও ক্লিপগুলো। শান্তর মুখে যেন এখনও হাসিমাখা।
কিন্তু পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এলো একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য—এ ছিল না তার প্রথম ঘটনা। অন্তত পাঁচজন নারী তার শিকার হয়েছেন, কারও সঙ্গে প্রেমের নামে, কারও সঙ্গে বিয়ের প্রলোভনে, আর কারও সঙ্গে টাকার বিনিময়ে। ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে হয়ে এমন অনৈতিক কাজে জড়াতে পারে তা উপস্থিত সকলকে হতবাক করে দেয়।
সিথী তখন থানার করিডরে বসে ছিলেন, চোখে ক্লান্তি আর রাগের মিশেল। তিনি জানতেন, এই লড়াই এখন শুধু নিজের জন্য নয়—এ লড়াই সেই সব মেয়েদের জন্য, যারা নীরবে ভয় আর লজ্জার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে।
ঢাকা থেকে প্রতারক শান্তর গ্রেপ্তারের খবর মিডিয়া প্রঙ্গনে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক থানায় এসে বিস্তারিত তথ্য ও শান্ত’র ছবি সংগ্রহ করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোতে শিরোনাম, প্রেমের ফাঁদে সর্বস্ব লুট অবশেষে প্রতারক গ্রেপ্তার / কক্সবাজার হোটেলে প্রেমিকা নার্সের গোপন ভিডিও, প্রেমিক আটক / খিলগাঁও থেকে প্রতারক গ্রেপ্তার।
থানার ওয়েটিং রুমে বসে নেট ঘাটছিলেন সিথী।হঠাৎ খবরটি দেখে শিউরে উঠল সে। তাঁর নাম সংবাদে নেই, কিন্তু ইঙ্গিত স্পষ্ট। তার চেনা-জানা লোকগুলো আশপাশে ফিসফাস করছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরিচিত আইডি থেকে তার মোবাইলে নোংরা ইনবক্স আসছে।
এদিকে শান্ত’র পরিবার নড়েচড়ে বসেছে। তার বাবা আলহাজ মাহবুবুল আলম ঢাকার বনস্রী এলাকার ধনাঢ্য গাড়ি ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের সাথে যোগাযোগ খুবই গভীর । গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মাথায় ঢাকা থেকে প্রাডো গাড়ি নিয়ে সকাল ১০টায় নোয়াখালী এলেন ছেলের বাবা মাহবুব আলম ও দুই জন মোচওয়ালা আইনজীবী। এসেই তারা সুধারাম থানায় হাজির হলেন । এ সময় তাদের সঙ্গী হলেন কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা।
থানার ওসির কক্ষে তর্ক-বিতর্ক শুরু করলেন তারা। বুঝতে পারল ওসি সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তাই এক নেতা প্রস্তাব দিলেন, ‘’ওসি সাহেব, যেথায় যা খরচ করতে হবে আমরা সেটা দেব। তবুও এই মামলাটা একটু ‘সেটেল’ করে ফেলুন। ছেলেটা ভুল করেছে, কিন্তু যে ভুলের কারণে ছেলেটির জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার মতো না।‘
ওসি ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এদেরকে দয়া দেখানো ঠিক নয়। কাল হয়তো আমার মেয়ে অথবা আপনাদের কারো মেয়ে এদের প্রতারণার শিকার হতে পারে। এখানে প্রমাণ আছে, ভিকটিমের অভিযোগ আছে। আমরা মামলা চালাবো। এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। প্লিজ আপনারা এবার যেতে পারেন। বাকিটা আদালত দেখবে।‘
দুপুর ১২টা। নোয়াখালী ফৌজদারী ট্রাইব্যুনাল কক্ষ। কক্ষের ভেতর হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো। চারদিকে চাপা গুঞ্জন। বিচারক তাঁর আসনে বসলেন। আইনজীবীরাও বসলেন। ভেতরে ও বাহিরে সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদের ভীড়।
আদালতের কর্মচারী উচ্চস্বরে ঘোষণা করলেন ‘রাষ্ট্র বনাম শান্ত মাহমুদ হাজির।‘
এরপর শান্তকে পুলিশ পাহারায় তোলা হলো আদালতের মঞ্চে। দু’হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত। পরিপাটি সাদা শার্ট, চুলে জেল, কিন্তু চোখে লালচে ক্লান্তি।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাফায়াত হোসেন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মাননীয় বিচারক, অভিযুক্ত শান্ত মাহমুদ বিভিন্ন নারীর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ধারণ করে, তা প্রকাশের হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় ও অনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য করেছেন। আমরা তদন্তে পেয়েছি এ ভিকটিম ছাড়াও আরো অন্তত চারজন ভুক্তভোগীর তথ্য। অভিযুক্তের মোবাইল, ল্যাপটপ, মেমোরি কার্ড ও অনলাইন ক্লাউডে থাকা কনটেন্ট পরীক্ষা করার জন্য তাকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি।‘
পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর সোহেল রানা উঠে দাঁড়ালেন, ‘মাননীয় আদালত, অভিযুক্ত অত্যন্ত চতুর ও প্রভাবশালী। গ্রেফতারের সময় তার মোবাইল থেকে আংশিক তথ্য উদ্ধার হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ প্রমাণ সে এনক্রিপ্টেড স্টোরেজে রেখেছে। পাসওয়ার্ড বের করতে ও অপরাধ চক্রের অন্য সদস্যদের শনাক্ত করতে আমাদের কমপক্ষে সাত দিনের রিমান্ড প্রয়োজন।‘
আসামী পক্ষের উকিল কামরুল কায়সার আপত্তি তুললেন, ‘মাননীয় বিচারক, আমার মক্কেল একজন সম্মানিত ব্যবসায়ী। রিমান্ডের নামে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার করা হতে পারে। আমরা রিমান্ডের বিরোধিতা করছি।‘
বিচারক বাদীপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘প্রমাণ উপস্থাপন করুন।`
রাষ্ট্রপক্ষ একে একে ভিডিও ফুটেজ, মেসেঞ্জার বার্তা, কলরেকর্ড, এমনকি শান্তর অন্য নারীদের সঙ্গে তোলা অন্তরঙ্গ ছবিগুলোও পেশ করল। আদালতের ভেতর চাপা ফিসফাস, কিছু সাংবাদিক ছবি তুলতে গোপনে মোবাইল ব্যবহার করছিল।
সবশেষে সিথী স্বাক্ষ্য দিতে দাঁড়ালেন। চোখে দৃঢ়তা, ও বুকে প্রতিশোধের সাহস নিয়ে বললেন, ‘আমি মানসম্মান ইজ্জত হারালেও ভয় পাইনি, আমি প্রতারক শান্ত’র বিচার চাই। নারীদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ইজ্জত ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়া এই শান্ত বাহিনীর সাথে আর কারা জড়িত সে তথ্য উদঘাটন করা খুব জরুরী। এ চক্রটি আরো চারজন মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। মান-সন্মানের ভয়ে ওরা সবাই নীরব ছিল। মাননীয় আদালত, আমিও যদি নীরব থাকি ওরা আরো কত মেয়ের মান-সন্মান ও ইজ্জত হরণ করবে তার সঠিক হিসাব হয়তো কেউ জানতে পারবে না। তাই আমি আজ নিজের সন্মান ও মর্যাদা বিবেচনা না করে মাননীয় আদালতে ন্যায় বিচারের আশায় সোচ্ছার হয়েছি। কারণ ওদের মত আমিও নীরব থাকলে এদের হাতে অসংখ্য নারীর জীবন নষ্ট হবে।`
বিচারক শান্ত গলায় বললেন, ‘অভিযুক্তের অপরাধের প্রকৃতি ও প্রমাণ নষ্টের ঝুঁকি বিবেচনায় পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ অপরিহার্য। অভিযুক্ত শান্ত রহমানকে পাঁচ দিনের পুলিশি রিমান্ড মঞ্জুর করা হলো। তদন্ত কর্মকর্তা নিশ্চিত করবেন যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় মানবাধিকার ও আইনি বিধান মেনে চলা হবে।`
আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ শান্তকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল। কোর্টের বাইরে বের হতেই সাংবাদিকরা মাইক্রোফোন এগিয়ে ধরল, ‘আপনি কি দোষী?`
শান্ত শুধু একবার ঘুরে তাকাল, তারপর মাথা নিচু করে পুলিশ ভ্যানে উঠে গেল।
সেই রাতেই সিথীর ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে কল— ‘ম্যাডাম, আমি শান্তর বড়ভাই বলছি। মামলা তুলে নিন, নচেৎ আপনার জীবনও শান্ত থাকবে না। টাকা লাগলে বলেন টাকা দেব।`
সিথী কল কেটে দিল, কিন্তু মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল। রাতের বেলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে লক্ষ্য করল, বিপরীতে একটি সাদা প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরে দু’জন মানুষ সিগারেট টানছে। গাড়িটি গত রাত ধরেই তার বাসার সামনে ঘোরাফেরা করছে।
পুলিশও উপরের চাপ অনুভব করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা সোহেল রানা একদিন সরাসরি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে, একা চলাফেরা করবেন না। কারণ ওরা মামলা ঠেকানোর জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। কারণ ওদের হাত অনেক লম্বা।`
সিথী দৃঢ় গলায় বললো, ‘এসবকে আমি ভয় পাই না। আপনি নির্ভয়ে আপনার কাজ চালিয়ে যান।‘
থানার ভেতরের একটি সুরক্ষিত কক্ষ। টিউবলাইটের আলোতে দিন রাতের তফাৎ বুঝা যায় না। কক্ষের মাঝখানে একটি টেবিল। টেবিলের উপর গাব গাছের দু’টি লাঠি, একটি যম টুপি ও কয়েক টুকরো রশি। টেবিল বরাবর উপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দুই হাজার ওয়াটের একটি ভাল্ব। টেবিলের নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে একটি ইলেকট্রিক শর্টগান। টেবিলের দু’পাশে দু’টি চেয়ার। কক্ষের এক কোণায় একটি জ্বলন্ত চুলা। দু’টি হাসের ডিম উত্তপ্ত পানিতে লাফালাফি করছে। একটি চেয়ারে এসে বসলো এস আই সোহেল রানা। পিছনে পিছনে মাঝায় রশি পরা শান্তকে নিয়ে ঢুকলেন এ এস আই মোস্তফা জব্বার।মোস্তফা জব্বার সুঠাম দেহী, যে কেউ তাকে দেখলে ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। দু’জন সিপাহী দরজায় পাহারা দিচ্ছে।
শান্ত এখনো শান্ত। তার চোখে আত্মবিশ্বাস, মুখে হাসি রেখে বললো, “আপনারা যতই চেষ্টা করেন, কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না।”
এস আই সোহেল রানা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “প্রমাণ? আমরা তো শুধু আপনার মুখ থেকে গল্প শুনতে এসেছি। আপনার মোবাইল থেকে শুরু করে বিদেশি সার্ভারে থাকা ডেটা সব আমাদের হাতে আসবে খুবই অল্প সময়ে। কিন্তু আপনি সত্য গল্প বললে অনেক কিছু সহজ হবে, আর মুখ খুলতে না চাইলে আপনার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।”
শান্ত হাসলো, “আপনারা জানেন না আমি কার সাথে ব্যবসা করি। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিদেশেও আমার সংযোগ আছে।”
সোহেল রানা সামনে ফাইল খুলে কয়েকটা প্রিন্টেড ছবি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘’ছবিগুলো সিথীর নয়, আরও তিনজন নারীর যাদের কেউ কাঁদছে, কেউ অনুরোধ করছে, কারও মুখে আতঙ্ক জমে আছে।‘’
শান্ত একটু থমকে গেল, কিন্তু হাসিটা ধরে রেখে বললো, “এগুলো কি প্রমাণ করে? ওরা তো আমার বন্ধু ছিল।”
এস আই সোহেল এবার ল্যাপটপ ঘুরিয়ে দিলেন। ভিডিও প্লে হলো, এক নারীর কণ্ঠ, কাঁদতে কাঁদতে নারী বলছে, “শান্ত, তুমি যদি ভিডিওটা ডিলিট না করো, আমি নিজেকে শেষ করে ফেলব…।”
ঘরে হঠাৎ নিস্তব্ধতা। এ এস আই মোস্তফা জব্বর চোখ বড় করে বললেন, ‘’তুই পিছনের দিকে তাকা, তোর পাছা গরম করতে দু’টি ডিম টগবগ পানিতে ফোঁটানো হচ্ছে। ওই মেয়েগুলো তোমার কেমন বন্ধু ছিল সেটা সিদ্ধ ডিমেই বলে দেবে। এতেও যদি সত্যটা না বল. এ দেখ টেবিলে নীচে ইলেকট্রিক শর্ট গান দিয়ে তোমার প্রতারণার যন্ত্রটা পুড়িয়ে দেব, যাতে তুমি কখনো বিয়ে করার নাম মুখে আনতে পারবে না। উপরে তাকাও ২০০০ ওয়াটের ভাল্ব, মাথার উপর কাছাকাছি এনে দুই ঘন্টা জ্বালিয়ে রাখব মাথার মগজ সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত।
এস আই সোহেল ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললেন, “তুমি যদি এখন সত্য কথা না বলো তাহলে তোমার ওপর কঠিন নির্যাতন হবে। এরপর মিডিয়ায় তোমার সব গোপন কর্মকান্ড ফাঁস হবে, তুমি সাদা মুখোসের আড়ালে কত বড় অপরাধী ও নোংরা মনের লোক এটা সবাই দেখবে।”
জব্বর দু’হাতে কালো মোটা গ্লাভস পড়ে ফুটন্ত পানির পাতিলটি টেবিলে এনে রাখে। ডিমগুলো যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আছে।
হঠাৎ শান্তর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। হাতের আঙুলগুলো অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছে। শরীরটাও কাঁপছে। কন্ঠের স্বর নরম করে বললো, “স্যার আমাকে আপনারা অভয় দিলে আমি সত্যটাই বলবো। প্লিজ এসব নির্যাতন করবেন না।“
এস আই সোহেল রানা স্বশব্দে হাত থেকে লাঠি টেবিলে রেখে বললো, ‘’ঠিক আছে, তোমাকে কিছুই করবো না। আমি যা জানতে চাইবো তুমি সেটার সঠিক জবাব দেবে।
-বললাম তো স্যার একদম সত্যটাই বলবো।
এস আই সোহেল রানা বললেন, “শুন শান্ত, তোমার এই চক্রে তুমি একা নও। বিদেশে থাকা মোহিন নামের যে লোক তোমাকে সার্ভার এক্সেস দেয়, সে এখন আমাদের হেফাজতে। সে সব বলে দিয়েছে।”
– “আপনারা… মোহিনকেও ধরেছেন?”
-শুধু মোহিন না, এক এক করে সবাইকে ধরবো। তোমার বাবাও আইনের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। এবার তোমার গল্পটা বল।
শান্ত গলায় কাশ দিয়ে শান্তভাবে বলে যাচ্ছে-
“আমি আসলে শান্ত মাহমুদ না… আমার আসল নাম শামীম উদ্দিন। আমেরিকায় কোনো নাগরিকত্ব নেই, শুধু কয়েকবার ট্যুরিস্ট ভিসায় গেছি। সেখানেই এ অপরাধ নেটওয়ার্কের সাথে পরিচয়।”
ইন্সপেক্টর সোহেল ভ্রু কুঁচকে বললেন, “নেটওয়ার্ক মানে?”
শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমরা চারজন মিলে এ কাজ করি। ১. রিয়াজ, সে থাইল্যান্ড থেকে সার্ভার কন্ট্রোল করে। সব ছবি, ভিডিও ও ডকুমেন্ট বিদেশি সার্ভারে আপলোড করে, যাতে বাংলাদেশি আইন সহজে অ্যাক্সেস না পায়। ২. মোহিন, সে ঢাকায় টার্গেট খোঁজে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে আকর্ষণীয় প্রোফাইল বানিয়ে নারীদের ফলো করে, ইনবক্সে আসে। ৩. আমি , ফিজিক্যাল কন্টাক্ট তৈরি করি। প্রেম, ভ্রমণ, উপহার দিয়ে মেয়েদের আস্থা অর্জন করি। তারপর অজান্তে বিশেষ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও তুলে রাখি। ৪. তানিয়া, সে চক্রের একমাত্র নারী সদস্য। সে নিজেকে ভুক্তভোগী সাজিয়ে অন্য মেয়েদের কাছে ‘বন্ধুর মতো’ এগিয়ে আসে, যাতে তারা দ্রুত আস্থা পায়।”
সোহেল রানা কথাগুলো নোট করছিলেন। শান্ত কথা চালিয়ে গেল, “প্রথম ধাপ হলো আমাদের টার্গেট বাছাই। সুন্দরী, অবিবাহিতা বা তালাকপ্রাপ্ত, সামাজিকভাবে একা তাদের অগ্রাধিকার। আর দ্বিতীয় ধাপ সম্পর্ক গড়ে তোলা। ভিডিও কল, উপহার, আমেরিকা ভ্রমণ বা সেটেল্ড হওয়ার স্বপ্ন দেখানো। তৃতীয় ধাপ, ‘অ্যাক্সিডেন্টাল’ ছবি ও ভিডিও। কখনও মোবাইল, কখনও হাই-এন্ড ক্যামেরা, যা এক ক্লিকে একাধিক ফ্রেম তুলে ফেলে একই সাথে ভিডিও ধারণ করা হয়।
চতুর্থ ধাপ, কনটেন্ট সিকিউর সার্ভারে আপলোড। পঞ্চম ধাপ, ব্ল্যাকমেইল। টাকা, গহনা, বা শারীরিক সম্পর্কের শর্ত। শেষ ধাপে টার্গেট ক্লান্ত বা দমে গেলে সব ডেটা বিক্রি করে দেওয়া। ক্রেতা থাকে বিদেশি ‘অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট’ ওয়েবসাইট।”
সোহেল রানা ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এটা কত বছর ধরে করছ?”
শান্ত উত্তর দিল, “প্রায় পাঁচ বছর। বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ভারত—সব জায়গায় টার্গেট ছিল।”
সোহেল গম্ভীর স্বরে বললেন, “তুমি বলো, আর কেউ জড়িত কিনা ওদের নাম দাও। তারপর আদালত তা বিবেচনা করবে।”
শান্ত নিচু গলায় বলতে শুরু করল, “আরো যারা জড়িত আছে ওরা সবাই বিদেশি। ওই বিদেশিরা আমার কাছ থেকে এসব ছবি, ভিডিও মোটা দাগে ডলার দিয়ে কিনে নেয়।
সোহেল রানা ডায়েরী ও রেকর্ডার বন্ধ করে চেয়ার ঠেলে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “শান্ত, আমাকে এখন যা বলেছো সব ডায়েরী ও রেকর্ড করা হয়েছে। এগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হবে। তুমিও আদালতে গিয়ে আমাকে যা বলেছ সব বলবে। শুধু তুমি না, তোমার নেটওয়ার্কের সবাই ধরা পড়বে।”
শান্ত মাথা নিচু করে রইল। যেন বুঝে গেছে, এবার আর বাঁচার পথ নেই।
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পর শান্ত হঠাৎ গভীর নিঃশ্বাস ফেলল এরপর বললো, “ঠিক আছে… আমি বলবো। কিন্তু প্রথমে প্রতিশ্রুতি দেন, সিথী ও আমার ভিডিও কোন সাংবাদিককে দেখাবেন না।”
কক্ষের টিউবলাইটের আলোতে শান্তর মুখ প্রথমবার ভেঙে পড়া মানুষের মতো লাগলো।
রিমান্ড শেষে আদালতে প্রথম হাজিরার দিন এলো। ভিড় ঠেলে শান্তকে আনা হলো, সাদা শার্ট, চুল সুন্দরভাবে আঁচড়ানো, ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। তার চেহারায় যেন কোন অপরাধবোধ নেই।
আদালত বসলো। বিচারক উভয় পক্ষের আইনজীবীর তর্ক-বিতর্ক শুনছেন।
আসামী পক্ষের আইনজীবী কামরুল কায়সার বললেন, ‘’মাননীয় আদালত, মামলার আরজিতে প্রমান আছে যে অভিযোগকারী স্বেচ্ছায় অভিযুক্তের সঙ্গে তিন রাত কাটিয়েছেন। ছবি এবং ভিডিওতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ স্পষ্ট।”
রাষ্ট্র পক্ষের উকিল, অ্যাডভোকেট সাফায়াত হোসেন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল, “এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মাননীয় আদালত, সম্মতির প্রশ্ন এখানে মূল নয়, মূল বিষয় হচ্ছে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা, ব্ল্যাকমেইলের উদ্দেশ্যে।”
তদন্তকারী কর্মকর্তা বললেন, ‘’মাননীয় আদালত, রিমান্ডে আসামি অকপটে সব দায় স্বীকার করেছেন। আমি আরো অধীকতর তদন্ত করে দ্রুত পরিপূর্ণ রিপোর্ট তৈরী করে যথাসময়ে মাননীয় আদালতে উপস্থাপন করবো।‘’
উভয়পক্ষের প্রায় আধা ঘন্টা তর্ক-বিতর্কের মাঝে আদালত আজকের মত সমাপ্তি হলো। শান্ত পুলিশ ভ্যানে উঠার সময় সিথীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলো, যেন বলছে— “তুমি জিততে পারবে না।”
সিথীর হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে গেল। সে বুঝল, এটা আর শুধু আইনগত মামলা নয়, এটা সমাজের অতি প্রভাবশালী বনাম দুর্বল নারীদের সত্যের লড়াই।
ইতোমধ্যে তদন্তে বেরিয়ে আসছে আরো ভয়ঙ্কর তথ্য—
শান্ত বিদেশ ভ্রমণের সময়ও এমন অনেক নারীকে ফাঁদে ফেলেছে, তাদের ভিডিও বিক্রি হয়েছে ডার্ক ওয়েবে। দুই বছর আগেও শান্তর বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ ধানমন্ডি থানায় দায়ের হয়েছে। আর তার প্রভাবশালী বাবার ছায়ায় আইনকে বোকা বানিয়ে সে খালাস পেয়েছে। তাই অভিযোগটি মামলায় গড়ায় নি। এবার প্রথমবারের মতো শান্ত আইনের হাতে বন্দি। মামলাটি কতটা আলোর মুখ দেখবে তা নির্ভর করছে সিথীর সাহস আর পুলিশের অটলতার ওপর।
মামলা চলমান অবস্থায় তদন্তকারী কর্মকর্তা সোহেল রানা বেশ কিছু ডিভাইস জব্দ করেছেন,দুটি ল্যাপটপ, তিনটি মোবাইল ফোন, আর একটি এক্সটার্নাল হার্ডড্রাইভ। এগুলোতেই ছিল সেই ভয়ঙ্কর ছবি ও ভিডিওগুলো।
সিথী ভেবেছিল, অন্তত প্রমাণ নিরাপদে আছে। কিন্তু ঘটনা তার ধারণার চেয়ে অনেক জটিল হয়ে উঠলো।
এক গভীর রাতে সোহেল রানার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন এলো “আপনি যদি নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে চান, ওই ডিভাইসগুলো হস্তান্তর করুন।”
সোহেল রানা গম্ভীর গলায় বললেন, “আপনি জানেন না কাকে ফোন করেছেন।”
কিন্তু কলের অপরপ্রান্তের লোকটি হেসে বলল, “আমরা জানি। আর আপনিও জানেন, এই খেলায় হারলে কী হয়।”
পরদিন সকালে থানার গেটের সামনে একটি কালো মাইক্রোবাস এসে থামল। ভিতর থেকে নেমে এলেন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, শান্তর বাবার পুরনো বন্ধু। ওসির কক্ষে প্রায় আধা ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে কথা হলো।
সিথী সেদিন হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলেন। দুপুরের দিকে তার বাসার কাজের মেয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফোন করলো, “আপা, বাসার দরজা কেউ খোলার চেষ্টা করতেছে। আমি চিৎকার দিছি, তারা দৌঁড় দিয়া পালাইছে।”
সিথী বুঝে নেয়, তাকে ভয় দেখানো শুরু হয়েছে।
সন্ধ্যায় থানায় গিয়ে সোহেল রানাকে সব বললেন। সোহেল বললেন, “ম্যাডাম, আমরা ডিভাইসগুলো সাইবার ক্রাইম ইউনিটে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি, তবে তাড়াহুড়ো করতে হবে। থানার ভেতরের কিছু লোকও ওদের সঙ্গে যোগসাজশে আছে বলে মনে হচ্ছে।”
সেই রাতেই, থানার স্টোররুমে রাখা প্রমাণ হঠাৎ আগুনে পুড়ে যায়। অফিসিয়ালি বলা হলো—‘শর্ট সার্কিট’। কিন্তু সোহেল রানা নিশ্চিত ছিলেন, এটা পরিকল্পিত।
সিথী খবর শুনে ভেঙে পড়ে। সিথী এসআই সোহেল রানাকে মোবাইলে কল দেয়, চোখের অশ্রু মুছে শুধু বললেন, ” স্যার, তাহলে কি সব প্রমান শেষ?”
সোহেল ধীরে ধীরে বললেন, “সব শেষ হয়নি। আমি জানতাম এমন কিছু হতে পারে, তাই আমি দ্বিতীয় ও তৃতীয় কপি করে খুবই নিরাপদে রেখেছি। কিন্তু সেটা এমন জায়গায় আছে, যেখানে ওরা কল্পনাও করবে না।”
সিথী আবার জানতে চাইলো, ‘’স্যার সেই কপিগুলো নিরাপদ থাকবে তো? কারণ শান্তর পরিবার এখন শুধু টাকা নয়, ক্ষমতা, ভয়, আর অন্ধকার দুনিয়ার সব হাতিয়ার ব্যবহার করছে।
-এটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। ওরা এত বেশি প্রভাবশালী সবাইকে ম্যানেজ করতে পারলেও অন্তত এ রানাকে পারবে না। প্রয়োজনে চাকরি যাবে তবু আমি সত্য উদঘাটন করে এর শেষ দেখতে চাই।
সোহেল রানা আলামতে কপি সংরক্ষণ এমন জায়গায় করেছে যা ছিল সবাইর সন্দেহর বাহিরে। একটি প্রমাণ রাখা হয়েছিল পুরনো জংধরা মোটরসাইকেলের ফুয়েল ট্যাংকের ভেতরে পলিথিন মুড়িয়ে মেমোরি কার্ড আকারে। ফুয়েল ট্যাংকটি রাখা হয়েছিল বাসার লাগোয়া বাইরের টয়লেটের ছাদের ওপরে। এই মেমোরি কার্ডটা অটুট থাকলে শুধু ওকে জেলে পাঠানো যাবে না, ওর পুরো সিন্ডিকেট ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো অপরাধী পক্ষ এ আলামতগুলো কবজায় নিতে সর্বত্র ওঁত পেতে রেখেছে।
সিথী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এত নিশ্চিত কিভাবে এটি হারাবে না?”
সোহেল ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল, ‘’টয়লেটের ছাদের মাঝ বরাবর থাকায় ফুয়েল ট্যাংকটি দেখা যায় না। আর চোখে পড়লেও ভাববে এটি পরিত্যক্ত ও জংধরা ট্যাংকি, কেউ ফেলে রেখেছে। আর দ্বিতীয় কপিটি এমন জায়গায় রেখেছি তা আপনাকেও বলা যাবে না।‘’
-ধন্যবাদ স্যার, মামলায় আমি জিততে পারলে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো চিরদিন।
-এ মামলায় কেবল আপনি জিতবেন না, জিতবে পুরো নারী সমাজ। কেউ যেন কখনো এমন ফাঁদে পা না বাড়ায়। আচ্ছা বোন এখন রাখি। হাতে আরো দু’টো জটিল মামলা আছে।
-ঠিক আছে স্যার , ভাল থাকেন।
– এই শোন, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। তুমি সাবধানে থাকবে। সরি তুমি বলে ফেললাম।
-তুমিই বলুন স্যার। এতে আমি খুশি হব।
-পথে একা বের হবে না। আর একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ করবো, রাখবে তুমি?
সিথী চিন্তিত হয়ে কিছুটা থেমে বললো, ‘’ আপনার অনুরোধ অবশ্যই রাখবো স্যার। তবে এমন অনুরোধ করবেন যেন আমি সহজেই রক্ষা করতে পারি, যাতে আপনার আর আমার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন না হয়।।
-ভয় পেয়ে গেলে মনে হয় ? এমন অনুরোধ করবো না, যাতে তোমার সামাজিক মর্যাদা আরো বাড়ে সেটাই বলব।
-কী সেটা বলুন স্যার।
-তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, তুমি মুসলিম মেয়ে। অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে আর খোদার কাছে ফরিয়াদ জানাবে যেন তুমি এ মামলায় কামিয়াব হতে পার এবং অতীতের সকল গুনা থেকে মুক্তি পাও।
-ঠিক আছে স্যার। সেটা চেষ্টা করবো।
– চেষ্টা যেন মন থেকে আসে। ওকে এখন রাখলাম।
এদিকে শান্ত জেল থেকে বের হওয়ার জন্য প্রভাবশালী লবিং শুরু করে দিয়েছে। হাইকোর্টে জামিন আবেদন হয়েছে। জামিন শুনানির তারিখ পড়েছে একমাস পর।
রাত তখন সাড়ে ১২টা । সিথী তখন তার ফ্ল্যাটে ল্যাপটপ দেখছিলেন। হঠাৎ বাইরের করিডোরে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। তারপর ধীরে ধীরে কেউ একজন দরজার হ্যান্ডেল ঘুরাতে শুরু করল।
দরজার হ্যান্ডেল ধীরে ধীরে ঘুরছে।
সিথীর নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ভাড়া বাসায় এই সময়ে এখানে কেউ আসে না।
হ্যান্ডেল ঘুরে থেমে গেল। নীরবতা। তারপর, টুক, টাক, টোক শব্দ।
তিনবার কড়া নাড়া হলো। এরপর কন্ঠ শুনা গেল, ‘’ম্যাডাম আমি বাসার সিকিউরিটি গার্ড, জরুরি কথা আছে।”
গলায় অদ্ভুত এক চাপা স্বর। সিথী ভিতরে দাঁড়িয়েই বললেন, “কি হয়েছে?”
বাইরের কণ্ঠ এবার ধীরস্বরে বলল, “আপনার বাসার গেইটে পাঁচজন ছেলে এসেছে। ওদের হাতে রাম দা ও পিস্তল। আমি তাদেরকে দেখে ওরা দেখার আগেই আমি উপরে উঠে এসেছি।
সিথীর মনে সন্দেহ জাগল। এই বাসার সিকিউরিটি গার্ডরা কখনো রাতে ভাড়াটিয়ার রুমে এসে খবর দেয় না। প্রয়োজন হলে বাড়িওয়ালার চার তলার ফ্ল্যাটে যোগাযোগ করে যে কোন সমস্যার সমাধান করে। তাছাড়া দুই দারোয়ানের কারো সাথে তেমন পরিচয়ও নেই।
সিথী বললো, ‘’আপনি বাড়িওয়ালার চার তলার ফ্ল্যাটে গিয়ে জানান।
-ম্যাডাম, উনারা সবাই গতকাল ঢাকায় গিয়েছেন। তাই আপনাকে জানাতে এলাম।
– আপনি এখান থেকে যান। কোন ভাড়াটিয়ার সাথে যোগাযোগ করুন। আমি মহিলা, আমার কিছুই করার নেই। আপনি যেতে পারেন।
সিথী চুপ করে ফোন হাতে নিয়ে সোহেল রানাকে কল করলেন। কল রিসিভ হতেই ফিসফিস করে বললেন, “কেউ দরজার বাইরে, সিকিউরিটি বলে পরিচয় দিচ্ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। প্লিজ আমাকে বাঁচান।
সোহেল রানার গলা কেঁপে উঠল, “দরজা খুলো না। আমি এক্ষুনি আসছি। আর, জানালা দিয়ে বাহিরে দেখার চেষ্টা করো। পরিবেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ কর।”
সিথী ধীরে ধীরে জানালার পাশে গেলেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলেন করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি গার্ডের পোশাকে নয়, কালো হুডি আর মুখ ঢাকা। এক হাতে পিস্তল, অন্য হাতে মোবাইল, যেন কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য স্ক্রীণে কারো নম্বর খুঁজছে।
হঠাৎ লোকটি মোবাইল কানে নিয়ে বলল, “ও বের হচ্ছে না। প্ল্যান বি লাগবে।”
সিথী আর দেরি করলেন না। দরজা থেকে সরে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে ছোট্ট একটি পেপার স্প্রে হাতে নিলেন। মনে মনে ভাবছে, এরা কি তাহলে শান্তর লোক? নাকি অন্য কেউ মামলা ও প্রমাণ নষ্ট করার পেছনে শেষ পথটা বেছে নিয়েছে।
দশ মিনিট পর সোহেল রানা সাথে অন্য একজন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে পৌঁছে গেল। কিন্তু তখন মেইন গেইটে তালা লাগানো, দারোয়ান গেইটের কিছুটা ভেতরে চেয়ারে হেলান দিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সোহেল রানা হোন্ডায় বসে জোরে হর্ণ টিপতেই দারোয়ানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। পুলিশ দেখে কথা বলার পর তালা খুলে দেয়। পুলিশ অফিসার জানতে চায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে বাসায় কেউ ঢুকেছিল কি-না। দারোয়ানের জবাব, স্যার আমি আধা আগ থেকে ওখানে বসে ঘুমাচ্ছিলাম। তাছাড়া রাত ৯টা থেকে গেইট বন্ধ ছিল।
পুলিশ অফিসার দুইজন দারোয়ানকে সাথে নিয়ে তিন তলায় উঠে যায়। সিঁড়ির পাশে প্রথম বাসায় নক করলেন সোহেল।
ভেতর থেকে জানতে চাইলো কে?
জবাবে বললেন, আমরা থানা থেকে এসেছি, আমি এস আই রানা।
ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ও আচ্ছা আপনি সোহেল রানা ?
দরজা খোলার পর সোহেল করমর্দন করে বললেন, আরে উকিল সাহেব আপনি এখানে?
-হ্যাঁ গত দুই বছর থেকে আমি এখানে পরিবার নিয়ে থাকি। এত রাতে হঠাৎ এখানে আগমন?
-বলবো, সবই বলবো। দ্রুত একটু আমাদের সাথে উঠুন। আপনার পাশে ৩/বি-৩ ফ্ল্যাটে ঢুকবো। তাড়াতাড়ি আসুন।
-ও আচ্ছা, সেই আলোচিত সাথী মেয়েটার বাসায়।
-সাথী নয়, সিথী।
৩/বি-৩ ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে সোহেল সিথীর নম্বরে কল দিয়ে বললেন, ‘’সিথী, আমরা এসেছি দরজা খোল।
সিথী কাঁপা হাতে সিটকিনি খুলে দরজা খুলতেই সোহেল রানা এক পা ভেতরে ঢুকে চারদিকে নজর বুলালেন।
তার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন প্রতিটি কোণা স্ক্যান করছে।
পুলিশ অফিসার সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন, “লোকটা কোন দিক দিয়ে গেল?”
সিথী এক মুহূর্ত থমকে থেকে করিডোরের দিকে আঙুল তুললেন, “দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আপনাকে ফোন দিয়েছি এটা শুনতে পেয়েছে সে”
সোহেল রানা ইশারা করতেই সঙ্গীয় অফিসার দ্রুত করিডোরের গ্রিল চেক করলো। গ্রিলের শেষ প্রান্তে গ্রিল লাগানো হয় নি এখনো। তার পাশে একটা সুপারী গাছ।
কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যেই সে ফিরে এসে বলল—
“স্যার, করিডোরের শেষ প্রান্তে গ্রিল লাগানো হয় নি এখনো। তার পাশে একটা সুপারী গাছ। মনে হয় ওই গাছ বেয়ে উঠেছে আবার নেমেও যেতে পারে।
সিথীর গলা শুকিয়ে গেল। ভাগ্যিস দরজা খুলি নাই। খুললে চরম একটা অঘটন ঘটেই যেত।
সোহেল রানা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “এটা কোনো সাধারণ ভয় দেখানোর জন্য নয়, এটা প্রমাণ নষ্ট করার সরাসরি চেষ্টা নয়তো তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা। তোমার কাজের মেয়েটা কোথায়?’’
-সে তো সকাল বিকাল একঘন্টা করে কাজ করে চলে যায়।
-তাই ওরা জানে বাসায় তুমি একা।
ঠিক তখনই করিডোরের নীচ থেকে হালকা একটা শব্দ শোনা গেল।
সোহেল হাত তুলে ঠোঁটের ওপর বড় আঙ্গুলটা রেখে সবাইকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন।
পুলিশ অফিসার পিস্তল বের করে ধীরে ধীরে করিডোরের গ্রিল বিহীন ফাঁকটার পাশে সুপারী গাছটির আগা থেকে নিচের দিকে দু’বার দেখলেন। সুপারী গাছটার নিচে বাউন্ডারী ওয়াল। ওয়ালের পাশে টিনের একচালা একটি ভাঙ্গা ঘর। ভাবছে ওই লোকটা পাশের পরিত্যক্ত বাড়ির টিনের একচালা ভাঙ্গা ঘরের চাল টপকে বাউন্ডারী ওয়ালে উঠে সুপারী গাছ বেয়ে উপরে উঠেছে আবার আমরা আসার আগে নেমে গেছে । এ সময় সোহেলের দৃষ্টি যায় কিছুটা দূরে পাড়ার একটি রাস্তার দিকে। ইশারা দিয়ে সঙ্গীদেরও দেখতে বললেন। দেখা যাচ্ছে একটি হোন্ডায় দু’জন আরোহী যেন কালো পোষাক পড়ে বিপরীত দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।
উকিল সাহেব বললেন, দেখতে র্যাবের পোষাক মনে হলেও তা নয়, এটা মনে হয় কালো পোষাকের অবয়বে মুখোস।
সোহেল দাঁত চেপে বললেন, “এদের নেটওয়ার্ক এখনও সক্রিয়। কিন্তু এ বার পালানোর রাস্তা বন্ধ করব।”
সিথীর বুক ধুড়ফড় করছে। তবুও তার মনে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে ধীরে ধীরে বললো, ‘’স্যার, আপনার সততা, আন্তরিকতা ও কর্তব্যপরায়নতা আমাকে এখনো সাহস যোগাচ্ছে।“
সোহেল সিথীকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘’কালকের মধ্যে তুমি বাসা পরিবর্তন কর। খুবই সিকিউরড একটা বাসায় উঠ। সেথায় ছয় সাত আট যে কোন তলায় ভাড়া নাও। নতুবা এই বাড়িওয়ালাকে বলে গ্রিল লাগানোর ব্যবস্থা কর। দিনের বেলায় কোথাও একা বের হবে না।‘’
-স্যার এ বাসাটা আমার হাসতাল থেকে একদম কাছে। তাছাড়া দিনের বেলায় বেশ জনাকীর্ণ পরিবেশ। এখানে কেউ অঘটন ঘটিয়ে পালাতে পারবে না।
সঙ্গীয় অপর অফিসার বললেন, একটা কাজ করুন। উনাকে হাসপাতালের এমডির সাথে কথা বলে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে খুই ভাল হয়।
উকিল সাহেব বললেন, ‘’এটাই ভাল প্রস্তাব। একটা নবজাতক চুরি হওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালের সিকিউরিটি ব্যবস্থা এখন খুই ভাল।‘’
সোহেল রানা বললেন, ‘’ঠিক আছে আমি কাল এমডি সাহেবের সাথে কথা বলবো।‘’
সিথী মৃদু হেসে বললো, ‘’আপনি বলা লাগবে না। আমি ম্যানেজারকে বললে হয়ে যাবে। আট তলায় আরো ৪ জন নার্স থাকেন, ওখানে আরো ৩টা রুম খালী পড়ে আছে।‘’
এস আই সোহেল কৌতুহলী কন্ঠে জানতে চাইলেন, ‘’তিন তলার করিডোরের সিসি ক্যামরার এডমিন কে?’’
উকিল বললেন, পুরো বাসার এডমিন বাড়িওয়ালা নিজেই। উনি এখন ঢাকায়, পরশু আসবে। আর তিন তলার এ ক্যামরার এডমিন আমিও।
-ঠিক আছে, আপনার রুমে চলুন। ক্যামরাটা চেক করবো।
সোহেল উকিল সাহেবের ল্যাপটপ খুলে ক্যামরার স্টোরেজ খুলে ঠিক ঘটনার সময়ের পাঁচ ছয়টি ছবি দেখে চমকে উঠলেন। দেখা যাচ্ছে করিডোরও ফাঁকা। কালো হুডি পরা লোকটি সুপরী গাছ থেকে নামছেন। করিডোরে হাঁটছেন, সিথীর দরজার হাতল ধরে আছেন। এর পরের ছবিতে এক হাতে পিস্তল, অপর হাতে মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলছেন। শেষটিতে দেখা যাচ্ছে সুপারী গাছ বেয়ে নেমে যাচ্ছে।
রহস্য আরও ঘন হয়ে গেল। সোহেল ধীরে ধীরে বললেন, “এরা শুধু ভয় দেখাচ্ছে না, আমাদের ট্র্যাকও করছে। এখন থেকে এক মিনিটের জন্যও একা থাকা যাবে না।”
সোহেল ল্যাপটপ থেকে ছবিগুলো তার ডিভাইসে নিয়ে নিলেন। এবার সিথী ও উকিল সাহেব থেকে বিদায় নিয়ে তারা দু’জন চলে গেলেন।
সকালবেলা হাসপাতালের নিজ কক্ষে বসে চা খাচ্ছিল সিথী। হাতে মোবাইল, তাতে সযত্নে সংরক্ষিত শান্তর কলরেকর্ড, মেসেঞ্জারের হুমকিমূলক বার্তা, কক্সবাজারের ছবি ও ভিডিওর স্ক্রিনশট, এবং অন্য নারীদের সাক্ষ্য।
সে ভাবছে, “শুধু লোকলজ্জার ভয় পেলে চলবে না। ওকে শাস্তি না দিলে ওর মতো লোক আরও অনেকের জীবন নষ্ট করবে।”
তাই সিথী সরাসরি এক পরিচিত জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করল। সাংবাদিক দিনার খানএকসময় হাসপাতালের কোনো এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। ফোন ধরতেই দিনার অবাক হয়ে বললো, “আপনি তো অনেক দিন পর কল দিলেন! কী খবর?”
-খবর ভাল না, খুবই বিপদে আছি। আমার কিছু প্রমাণ আছে, কিন্তু এগুলো আদালতে নেওয়ার আগে মিডিয়ায় প্রকাশ করা দরকার।
দিনার ঘটনা শুনলেন। প্রমাণগুলোর বিবরণ শুনে বললো, “এটা একেবারেই সিরিয়াস ব্যাপার। আপনার অনুমতি পেলে আমি ‘প্রতারক প্রবাসী প্রেমিক, অশ্লীল ভিডিও ধারণ, অবশেষে গ্রেপ্তার, মামলার অগ্রগতি ও গভীর রাতে হত্যার চেষ্টা এসব ’ শিরোনামে স্টোরি চালাতে পারি। তার আগে আমাকে আপনার হাতে থাকা প্রমাণগুলো সাথে থানা ও আদালতে মামলার পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির ফটোকপি দিতে হবে। নইলে উল্টো শান্ত মানহানির মামলা করে দিতে পারে।”
সেদিন বিকেলে সিথী নিঃশব্দে পৌঁছে যায় মাইজদীর এক কোণে ছোট্ট একটি মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এই জায়গায় অপেক্ষা করছিলেন সাংবাদিক দিনার খান। দু’জন নাস্তা ও কফির অর্ডার দিয়ে বসেন। কফির ধোঁয়ার ভেতর সিথীর কণ্ঠে যেন একরাশ অভিমান, ক্ষোভ ও সত্যের ঝলক নিয়ে বেরিয়ে আসে শান্তর প্রতারণার শিকার হওয়ার সমস্ত ঘটনা, অসংখ্য ছবি, কল রেকর্ড, মামলার কপি, এমনকি হত্যার পরিকল্পনার সিসি ক্যামরার চিত্র। সবই খুলে বলে সে। হাতে ধরা প্রমাণের ফাইল টেবিলে রেখে বিদায়ের প্রস্তুতি নেয়।
দিনার খান নরম স্বরে বললেন,“আপা, আর পাঁচ মিনিট থাকুন। আমার কয়েকজন সহযোদ্ধা সাংবাদিক আসছে, ওদেরকে আপনার মুখ থেকে শোনাতে চাই।”
সিথী ঘড়ি দেখে বললো, “কখন আসবে? আমার তো ডিউটি আছে।”
দিনার খান প্রধান দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “এই তো এসে পড়েছে।”
পরিচয় পর্ব শেষে সবাই চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ছোট কনফারেন্স কক্ষে চলে যায়। একে একে সবার টেবিলে নাস্তা আর কফি রাখা হয়। দিনার খান পাশে বসা সাংবাদিক সোহেলকে জিজ্ঞেস করলেন, “আকবর আর আকাশ আসছে না?”
সোহেল উত্তর দিল, “না, ওদের অন্য প্রোগ্রাম আছে। তবে সমস্যা নেই। আমি নিউজ সাজিয়ে ইমেইল করে দেব, সবাই নিজের মত করে নিউজ তৈরী করে নিজ নিজ প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দেবে।”
সোহেলের পাশের চেয়ারে বসা এ আর আজাদ বললেন, “প্রমাণগুলো নাগরিক টিভির সোহেলকে দিন, সে সাজিয়ে দেবে।”
সিথী ধীরে দাঁড়িয়ে, জোড়হাত তুলে বলল, “ভাইজানরা, আমার ডাকে সাড়া দিয়ে আসার জন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে শুধু একজন ভুক্তভোগী হিসেবে আসিনি। আমি এসেছি একজন যোদ্ধা হিসেবে, যে নিজের ক্ষতকে ঢেকে রাখতে চায় না, বরং সেই ক্ষতকে প্রমাণ বানিয়ে অপরাধীর মুখোশ খুলে দিতে চায়।”
তার চোখে দৃঢ়তা ঝিলমিল করে উঠল, “হ্যাঁ, এই খবর ছাপা হলে আমার চরম মানহানি হবে, সেটা আমি জানি। কিন্তু আমার মানসন্মান বিকিয়ে একার জন্য লড়ছি না আমি, আমি লড়ছি তাদের জন্য, সেই অসংখ্য মেয়ের জন্য যারা প্রতিদিন ভেতরে ভেতরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ মুখ খুলতে লজ্জা ও ভয় পায়। আমি চাই, আমার মত যেন আর কোনো নারীকে একই অন্ধকারে না ঠেলে দেয়। আমি চাই, এই প্রতারকরা যতই প্রভাবশালী হোক, তারা যেন বুঝে যায়, নারীর কণ্ঠ চুপ করানো যায় না, সত্য চেপে রাখা যায় না।”
নীরব কক্ষে সিথীর কণ্ঠ যেন গর্জে উঠল। সাংবাদিকরা একে অপরের দিকে তাকালেন। টেবিলের উপর রাখা প্রমাণের ফাইল তখন আর শুধু কাগজের স্তূপ নয়, ওটা ছিল একজন নারীর যুদ্ধের অস্ত্র।
সিথী হোটেল ক্যাশের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়েটারের দেওয়া বিলের কাগজটি এক পলক দেখে নেয়। পার্স খুলে দুইটি হাজার টাকার নোট বের করে নেয়। দিনার দৌঁড়ে এসে বিলের কাগজটি কেড়ে নিতে চেষ্টা করে। সিথী প্রতিরোধ করে বলে, ভাইয়া আমার প্রতি মাসে জব ও প্রাইভেট সেবায় রোজগার হচ্ছে ষাট হাজার বা তারও উপরে কিন্তু খরচ করার মত লোক পাই না। আমি সিংগেল। ১৮০০ টাকা বিল দিয়ে একশ টাকা ওয়েটারের হাতে ১০০ টাকা বখশিস ধরিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
সন্ধ্যা নামতেই সোহেল তার অফিসে বসে খবর সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সহযোদ্ধাদের মেইলে। ওরা নিজের মত এডিটি করে নিজ নিজ জাতীয় দৈনিক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর টিভি চ্যানেলের ডেস্কে পাঠায়। খবরের শিরোনাম যেন আগুন ছড়িয়ে দিল।
“প্রবাসী পরিচয়ে প্রতারণা, নারীর জীবন নিয়ে খেলা: সাইবার চক্রের মুখোশ উন্মোচন, নিজের সন্মান বিকিয়েও অন্য নারীদের জন্য যুদ্ধ করছেন এক নারী, এক নারী যোদ্ধার নতুন অধ্যায়।” ইত্যাদি শিরোনামে খবর আসে।
পরদিন সকাল থেকেই সিথীর ফোনে কলের বন্যা। সহকর্মী, আত্মীয়, এমনকি অচেনা নারীরাও পত্রিকা অফিস বা জেলা প্রতিনিধির কাছ থেকে সিথীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের প্রতারণার গল্প শোনাতে লাগল। অনেকে বললো, “আপা, আপনার সাহস আমাদের নতুন করে সাহস যোগাচ্ছে।”
এদিকে শান্তর নেটওয়ার্কে তীব্র অস্থিরতা। ঢাকার বনানীর একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসে চক্রের মূল হোতা বিদেশে পালানোর পথ খুঁজছে। কেউ আবার পরিচিত এক আইনজীবীর মাধ্যমে চেষ্টা করছে সিথীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দিতে।
কিন্তু সাংবাদিকদের অনুসন্ধান যেন থামছে না। প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে, শান্তর পুরোনো প্রেমিকাদের ছবি বিক্রির ঘটনা, বিদেশে বিয়ে করার ভুয়া ডকুমেন্ট, ব্যাংক লেনদেনের প্রমাণ।
সন্ধ্যায় টিভি চ্যানেলের একটি লাইভ টকশোতেও সিথী দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “এমন প্রতারণার শিকার আমি একা নই। আমার মত আরো অনেকে আছে। সেই সব নারীদের প্রতি আমার আহবান, আপনারাও এগিয়ে আসুন। যে যেভাবেই প্রেমের ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন এবং ন্যায় বিচার পাবেন না ধারণা করে এতদিন চুপ থেকেছেন, তারা ফাঁদপাতা প্রতারকের বিরুদ্ধ এগিয়ে আসুন। একটা অপরাধ জন্ম দেয় শত শত অপরাধের। আজ আমরা সবাই একসাথে বলি, এবার শেষ হোক এই প্রতারণার খেলা।”
ক্যামেরার লেন্সে সিথীর মুখ তখন ক্লান্ত কিন্তু অদম্য। বাইরে শহরের আকাশে বৃষ্টি নামছে, আর ভেতরে যেন শুরু হয়েছে এক নারী যুদ্ধের নতুন অধ্যায়।
লাইভ শেষ হতেই সিথীর ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে কল। বললো, “তুই বুঝতে পারছিস না কী করেছিস? তোর ভিডিও এখনই ছড়িয়ে দেব।”
সিথী ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, “দে। তুই দিস। পর্ণো সাইটে বিক্রি করে আমাকে তো সারা বিশ্বে যৌণ তৃপ্তির পাত্র বানিয়েছিস, এতে সন্মানহানী আমার একার হবে না, তোদের গ্যাং লিডার শান্তরও যাবে। আমি তো চাই পুরো দেশ দেখুক, বিশ্ব দেখুক তোরা কত বড় নোংরা মানুষ।”
-তুই কেমন মেয়ে? নিজের সন্মান নিয়ে একটুও ভাবিস না!
-আমি আমার সন্মান নিয়ে ভাবছি না, তোরা তোদের বসের সন্মান নিয়ে ভাব।
-বসের মুখ দেখা যাবে না, তার মুখ ঝাপসা করে রাখা হবে, এমনটা শর্তে কন্ট্রাক্ট হয়েছিল। শুধু তোকে দেখা যাবে। আর দেশের ভেতর স্ক্রীণশর্ট নিয়ে শুধু তোর ছবিই ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এখানেই শেষ নয়, বাড়াবাড়ির অপরাধে তোর প্রাণটাও যাবে।
সিথী অনেকটা উচ্চস্বরে বললো, তোরাও কেউ মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারবি না। এক এক করে তোদের সবাইকে চৌদ্দশিকে আটকানো হবে যেন তোরা আর কখনো ফিনিক্স পাখীর মত বার বার পয়দা হতে না পারিস বলেই ফোন কেটে দেয়।
ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে সিথী একটি টিস্যুপেপার নিয়ে কপাল মুখ ও গলা মুছে নিলেন, ভাবছে এখন কেবল শান্ত চৌদ্দ শিকে, বাহিরে যারা আছে তাদেরকেও আইনের চাকায় পিষ্ট করতে হবে।
কিছুক্ষণ পর সিথী এস আই সোহেলকে হুমকির বিষয়টি জানাতে কল দেয়, ‘’স্যার, একটু আগে অপরিচিত নম্বর থেকে আমাকে আবারও কল দিয়ে থ্রেট দিয়েছে। সম্ভবত লাইভ দেখে এ হুমকি দিতে পারে।‘’
-তুমি ভেঙ্গে পড়বে না। কাল সকালে থানায় এসে একটা জিডি করে রাখ। আমি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাহায্য নিয়ে তাকেও গ্রেপ্তার করবো। তোমাকে আমরা সুরক্ষা দিবো। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে হুমকিদাতার অবস্থান শনাক্ত করে আমরা তাকেও ধরব।
-ঠিক আছে স্যার। ধন্যবাদ।
সিথীকে নিয়ে দেশের মানুষের সমর্থন ও কৌতূহল ক্রমেই বাড়ছে। এদিকে কারাগারে শান্ত মাহবুব দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে। আদালতের জবানবন্দি ও সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ তাকে ক্রমাগত মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলছে।
এই অবস্থায় শান্তর স্ত্রী তাহমিনা ঠিক করল- কোনো না কোনোভাবে আপোষ করতে না পারলে তার স্বামীর মুক্তি অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই একদিন সে কালো রঙের প্রাডো গাড়ি নিয়ে হাজির হলো নোয়াখালীর সেই হাসপাতাল কক্ষে। তখন সিথী রোগীদের রেজিস্ট্রার খাতা দেখছিল।
মহিলাটি সালাম দিয়ে বলল, “আপা, বসতে পারি?”
সিথী হাতের তর্জনী দিয়ে সামনে থাকা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। চোখ তুলে মহিলার দামি বেশভূষা দেখে কিছুটা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনি?”
তাহমিনা ইতস্তত করে বলল, “আপা, রাগ করবেন না তো? একটা অনুরোধ নিয়ে আমি ঢাকা থেকে এসেছি।”
-ঠিক আছে, আগে নিজের পরিচয় দিন। তারপর শুনব কী অনুরোধ নিয়ে এত পথ এসেছেন।
-আপা, আমি শান্তর স্ত্রী… তাহমিনা খানম।
শান্তর নাম শুনতেই সিথীর মাথা গরম হয়ে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললেন, “ও আচ্ছা, সেই পশুর স্ত্রী আপনি? দয়া করে আর কিছু বলবেন না। আমি এখনই পুলিশ ডাকছি।”
সেই মুহূর্তেই সিথীর মাথায় আরেকটা চিন্তা এল, “না, তিনি একজন নারী, আমার মতোই। আগে শুনি তিনি কী বলতে চান।”
তাহমিনা এবার সরাসরি অনুনয়ের সুরে বলল, “আপা, আমি জানি শান্ত অনেক ভুল করেছে। কিন্তু আপনারাও জানেন, লাভ-লোকসানের খেলায় মানুষকে ব্যবহার করা হয়। যদি আপনারা চান, শান্তর বিরুদ্ধে এই মামলায় সাক্ষ্য না দেন, তবে আমার স্বামী বাঁচতে পারে। এর বিনিময়ে আমি আপনি যা চাইবেন তাই দিতে রাজি আছি—বাড়ি, গাড়ি, অর্থ—যা বলবেন।”
সিথী রাগ সামলাতে না পেরে আবার উঠে দাঁড়ালেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “ম্যাডাম, এ ব্যাপারে আমাদের এখন কিছুই করার নেই, পাপের শাস্তি অবশ্যই হওয়া উচিৎ। সত্য গোপন করলে শুধু অপরাধীই নয়, আমরা নিজেরাও অপরাধী হয়ে যাব।”
তাহমিনা কান্নায় ভেঙে পড়ল। চোখ মুছতে মুছতে অনুনয় করল, “আপনাদের করুণা ছাড়া আমার স্বামীর মুক্তির কোনো রাস্তা নেই। একবার ভেবে দেখুন, আমি আপনাদের পায়ের ধুলো নিতে রাজি।”
সিথীর কণ্ঠ এবার আরও কঠোর হয়ে উঠল, “করুণা দেখানোর সময় বহু আগে শেষ হয়েছে। শান্ত আমার জীবন ধ্বংস করেছে, আর কত মা-বোনকে পথে নামিয়েছে তার হিসেব নেই। ন্যায়বিচারের পথ থেকে আমরা সরে আসব না। আপনি ঢাকায় ফিরে যান। আদালতই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।”
কিছুক্ষণ হতাশায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল তাহমিনা। তারপর মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল। বাইরে প্রাডোর ইঞ্জিন গর্জে উঠল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সিথী গভীর শ্বাস ফেলল, “অন্যায়ের সাথে আপোষ মানেই নিজের মৃত্যু। আমি বাঁচব ন্যায়ের পথেই।”
বেলা ১১টা। স্নিগ্ধ দিনের শুরু। নোয়াখালী ফৌজদারী ট্রাইব্যুনাল কক্ষ। হাজির হলেন মামলার উভয় পক্ষ। সিথী, যার জীবনের অন্যতম কঠিন সময় এখন, আদালতের সেই কক্ষে তার চোখে একটু হলেও আশা জ্বলছে। শান্ত মাহবুব, যার মিথ্যা মোড়কে মোড়ানো জীবন আজ আদালতে উন্মোচিত হতে চলেছে।
কক্ষের ভেতর হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো। চারদিকে হঠাৎ চাপা নীরবতা। বিচারক তাঁর আসনে বসলেন। আইনজীবীরাও বসলেন। ভেতরে ও বাহিরে সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদের ভীড়।
তদন্তের রিপোর্ট আদালতে জমা পড়লো। এস আই সোহেল তার প্রতিবেদন তুলে ধরলেন। অনেক তথ্য আমরা উদ্ধার করেছি, যেগুলো তার প্রতারণার সাক্ষ্য বহন করে। তদন্তে উঠে আসে তার বহু অন্য তরুণীর সঙ্গে একই পদ্ধতিতে প্রতারণার কাহিনী। মিথ্যা পরিচয়ে সম্পর্ক গড়ে ভোগের পাশাপাশি বিপুল অর্থ আদায় করত সে। এ ধরনের অভিযোগ আমরা অনেক পেয়ে থাকি কিন্তু মামলা করার ইচ্ছুক ভিকটিম খুব কম। তাদের মাত্র ১০% ঘটনা মামলা পর্যন্ত যায়। এর অধিকাংশই মামলার শুরুতে উভয় পক্ষ মিমাংশা করে ফেলেন। এই মামলার ভিকটিম মিসেস ফারজানা ইসলাম আকতার সিথী একজন সাহসী, স্বাধীনচেতা ও প্রতিবাদী নারী। তাকে প্রথমে টাকা ও পরে বিভিন্ন মোবাইল থেকে হুমকি দিয়েও থামাতে পারে নি। গত ২৩শে মার্চ রাত ১২টার সময় আসামী পক্ষের কেউ মুখোস পড়ে পিস্তল হাতে নিয়ে তার শয়ন কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। তিনি সাথে সাথে আমাকে মোবাইল করে জানায়। দুষ্কৃতিকারী ব্যক্তিটি সিথী ও আমার কথোপকথন শুনে দ্রুত পালিয়ে যায়। আমি এ সময় সঙ্গীয় এক অফিসারকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছি। সিসি ক্যামরা দেখে তাকে চিনতে পারিনি, কারণ সে হুডি পড়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। তিনি এর শেষ দেখতে চান। মাননীয় আদালত, অভিযুক্ত শান্ত মাহবুব মিথ্যা পরিচয়ে অন্তত চারটি নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেছে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। গোপন ক্যামেরার ভিডিও ক্লিপগুলোই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। অনেক ভিডিওতে নারীদের সম্মতি ছাড়া গোপনধর্মী ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি রয়েছে, যা শান্ত ভয়ভীতি দেখানোর কাজে ব্যবহার করত। সিথীসহ অপরাপর প্রত্যেকটি কল রেকর্ড, ক্যামরায় তোলা ছবি, ভিডিওসহ সকল প্রমাণ আপনার সদয় অবগতির জন্য অত্র রিপোর্টের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।
শান্তর পক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা থেকে আগত নামকরা আইনজীবী ব্যারিস্টার তানবীর হায়দার যিনি মক্কেল রক্ষায় বিপক্ষের যেকোন যুক্তি খন্ডাতে অভিজ্ঞ। ব্যারিস্টার বললেন, “প্রমাণিত হয়নি আমার মক্কেল কোনো অপরাধ করেছে। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। ভিডিও ও ছবি দু’পক্ষের সম্মতিতেই ধারণ করা হয়েছে। এটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়। উভয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিক্ষিত। এখানে বল প্রয়োগ করার প্রশ্নই আসে না। কোনো ধরনের ব্ল্যাকমেইলিং বা হুমকি চালানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন। সিসি ক্যামরায় পিস্তল হাতে যে লোকটিকে দেখানো হয়েছে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমার মক্কেলকে ফাঁসানোর জন্য সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে কাউকে দিয়ে সাজানো হয়েছে। পর্ণো সাইটে ভিডিও বিক্রি করে ডলার উপার্জনের অভিযোগটিও মিথ্যা এবং এর কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। তাছাড়া আমার মক্কেল ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার ধন সম্পদের কোন কমতি নেই। অনৈতিক কাজে জড়ানোর প্রশ্নই উঠে না। প্রমাণিত হয়নি আমার মক্কেল কোনো অপরাধ করেছে। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। । মাননীয় আদালত আমার মক্কেলকে দায়মুক্তি দেওয়া হোক।
সিথীর পক্ষে লড়ছেন জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার আইনজীবী সুমনা আক্তার, যিনি নারীদের অধিকার ও সাইবার নিরাপত্তার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তিনি দাঁড়িয়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেন, ব্যারিস্টার জনাব তানবীর হায়দারের যুক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। প্রকৃত ঘটনাটি তথ্য প্রযুক্তি ও সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত। ভিকটিমদের সম্মতি ছাড়াই গোপন ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ এবং ব্যবহার অপরাধমূলক। এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক হয়রানির জন্য কঠোর শাস্তির দাবি রাখে। মেসেজ, কল লগ, ভিডিও ও ছবি যেগুলো ব্যক্তিগত সম্মতির বাইরে। অভিযুক্ত আইনি বাধা উপেক্ষা করে ভিকটিমকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। এ ছাড়া তার ফোন থেকে আমরা পেয়েছি হুমকিস্বরূপ মেসেজ, যা স্পষ্ট অপরাধ প্রমাণ করতে যথেষ্ট।
ব্যারিস্টার তানবীর হায়দার দাঁড়িয়ে কোর্টের দিকে তাকালেন। তাঁর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, “মাননীয় আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ যে অভিযোগ তুলছে তা কেবল অনুমাননির্ভর। ভিডিও ও ছবি দু’পক্ষের সম্মতিতেই ধারণ করা হয়েছিল। এটি একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক—এখানে অপরাধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সিসি ক্যামেরায় যে অস্ত্রধারীকে দেখা গেছে, তাকে অভিযুক্ত শান্ত মাহবুব প্রমাণ করার মতো কোনো বৈজ্ঞানিক বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। আমার মক্কেল একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, যার অর্থ বা প্রভাবের অভাব নেই। তিনি কেন এমন অবৈধ কাজে জড়াবেন?”
এবার সিথীর আইনজীবী সুমনা আক্তার দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন: “মাননীয় আদালত, ব্যারিস্টার মহোদয় বলেছেন ভিডিওগুলো সম্মতিতে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আইন স্পষ্টভাবে বলছে, যেকোনো প্রকার গোপন ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ অপরাধ। অভিযুক্ত সেই ভিডিও দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে, যা আইনের দৃষ্টিতে সরাসরি অপরাধ। কল লগ, ভয়েস রেকর্ড, হুমকির বার্তা সবই আদালতের দায়ের করা হয়েছে।‘’
আসামী পক্ষের অপর আইনজীবী কামরুল কায়সার আদালতের সামনে হাত উঁচিয়ে বললেন: “মাননীয় আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ যে অভিযোগ তুলছে তা কেবল অনুমাননির্ভর। এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, মাননীয় আদালত। আমার মক্কেলকে সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা চলছে। তাই আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। তাকে দায়মুক্তি দেওয়া হোক।”
সিথীর পক্ষের স্থানীয় আইনজীবী সাফায়াত হোসেন অনুমতি নিয়ে বললেন, এ ধরণের জগন্য অপরাধমূলক মামলা ৯৫ ভাগই হুমকি, আইনের দীর্ঘসূত্রতা, মামলার খরচ চালানো, মানসন্মানের ভয় ইত্যাদি কারণে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক ভিকটিম লজ্জা ও সামাজিক চাপে মামলায় যায় না। অথচ মিসেস ফারজানা আকতার সিথী সাহস করে আদালতে দাঁড়িয়েছেন। তাই এই মামলা কেবল তাঁর জন্য নয়, বরং নারীর অধিকার, মর্যাদা ও সাইবার নিরাপত্তার জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শান্ত মাহবুব যদি নির্দোষ হন তবে তিনি প্রমাণ দিন। কিন্তু তাঁর মোবাইল থেকে উদ্ধার হওয়া হুমকিমূলক ম্যাসেজই প্রমাণ করে তিনি দোষী।”
আসামী পক্ষের আইনজীবী কামরুল কায়সার উচ্চস্বরে বললেন, অভজেকশন ইউর অনার, মানসন্মানের ভয়ের কারণে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক ভিকটিম লজ্জা ও সামাজিক চাপে মামলায় যায় না আমার প্রতিপক্ষের আইনজীবীর এ অভিযোগ একদম মিথ্যা। দেশের প্রতিটা আদালতে অসংখ্য মামলা এখনো চলমান। অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা ও সাজানো। শুধু কেবল আসামীকে অপবাদ দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এ মামলাটিও তেমন। মিথ্যা ও বানোয়াট।
আদালত রুমে আবারও চাপা ফিসফাস। বিচারক তাঁর হাতুড়ি ঠুকে সবাইকে চুপ করালেন। তিনি বলেন: “আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনেছে। তদন্ত রিপোর্ট, প্রমাণপত্র ও যুক্তি–তর্ক আমরা পর্যবেক্ষণ করব। পরবর্তী শুনানির তারিখ ঘোষণা করা হবে।”
বিশদিন পর আদালত কক্ষ ভরে গেছে আইনজীবী, সাংবাদিক ও দর্শকে। বিচারক প্রবেশ করতেই পুরো কোর্টরুম নিস্তব্ধ। বিচারক মামলার কার্যক্রম শুরু করতে বললেন।
পুলিশ কর্মকর্তা এস আই সোহেল রানাকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাফায়েত হোসেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘’ আপনি ২৩শে মার্চের রাতের ঘটনাটি বিস্তারিত বলতে পারবেন?’’
সোহেল রানা মাথা নেড়ে বললেন, ‘’হ্যাঁ মাননীয় আদালত। আমি সরাসরি ভিকটিমের মোবাইল কল পাই এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে দরজার চিহ্ন ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করি। সেখানে অস্ত্রধারী একজনকে দেখা যায়। পরবর্তীতে ভিকটিমের ফোন থেকে একটি হুমকিমূলক বার্তাও পাই।”
ব্যারিস্টার তানবীর প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি নিশ্চিত বলতে পারেন, ক্যামেরায় যিনি আছেন তিনি শান্ত মাহবুবের পক্ষের কেউ?”
সোহেল সরলভাবে বললেন “না, মুখ ঢাকা থাকায় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”
তানবীর হাসলেন, দর্শকদের দিকে তাকালেন।
-মানে আপনার কাছে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। ধন্যবাদ।
এবার ডাকা হলো ফারজানা আকতার সিথীকে। পুরো কোর্টরুমে নীরবতা নেমে এলো।
বিচারক সিথীকে সতর্ক করলেন, “আপনি যা বলবেন, সত্য বলবেন।”
সিথী স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, “আজ থেকে ৬ মাস আগে একদিন ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল এই মানুষ নামের এ জানোয়ারের সাথে।
-অবজেকশন ইউর অনার।
বিচারক সিথীর দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ আপনি বলে যান।
–সে আমাকে প্রতিদিন স্টার গিফট পাঠাতো। প্রথমে আমি তাকে বুঝতে পারি নি। এরপর প্রায় হাই হ্যালো করতো ম্যাসেঞ্জারে। পরে আমিও সাড়া দি। বন্ধুত্ব গাঢ় হলে সে আমাকে বিয়ের প্রলোভন ও আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। একদিন সে বলে একমাস পর আমেরিকা ফিরে যাবে। যাওয়ার আগে আমরা বিয়ে করবো, আমেরিকা যাওয়ার সময় আমার পাসপোর্টের কপি সে নিয়ে যাবে। চার মাসের মধ্যে ভিসা লাগাবে এবং আমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাবে। আমি খুবই খুশি হলাম, তাকে ধন্যবাদ জানালাম। ধন্যবাদ পরক্ষণে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সে বলে ধন্যবাদ চাই না, চাই তোমাকে নিয়ে পরশু দিন কক্সবাজার ঘুরবো। তিনদিন পর ফিরে আসবো। ওখানে আমরা স্বামী-স্ত্রীর মত রাত কাঠাবো……………………….। তবে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম শান্ত একজন ভালো মানুষ। কিন্তু সময়ের সাথে বুঝতে পারি, সে আমার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের ফাঁদ সৃষ্টি করেছে। আমাকে আমার ছবি ও ভিডিও দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। আমি আইনের ভয় দেখালে সে আমাকে খুনের হুমকি দেয়। আমি এই মামলার মাধ্যমে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করছি।
ব্যারিস্টার তানবীর প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
“আপনি স্বেচ্ছায় কি কখনো আসামির সাথে ছবি বা ভিডিও তুলেছেন?”
সিথী একটু থেমে উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ, সম্পর্কের সময় কিছু ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু গোপন ক্যামেরায় যে ভিডিও করা হয়েছে, তার কোনো অনুমতি আমি দিইনি।”
তানবীর দ্রুত বললেন, “তাহলে আদালত দেখুক, সম্পর্ক ছিল দুজনের সম্মতিতেই। এখন ক্ষোভে আপনি মিথ্যা অভিযোগ আনছেন।”
সিথী দৃঢ়ভাবে তাকালেন বিচারকের দিকে, “না, মাননীয় আদালত। আমি মিথ্যা বলছি না। আমি একা নই, আরও নারী একই প্রতারণার শিকার হয়েছেন।”
এবার সুমনা আক্তার দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “মাননীয় আদালত, ব্যারিস্টার মহোদয় বলেছেন ভিডিওগুলো সম্মতিতে ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আইন স্পষ্টভাবে বলছে, যেকোনো প্রকার গোপন ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ অপরাধ। অভিযুক্ত সেই ভিডিও দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে, যা আইনের দৃষ্টিতে সরাসরি অপরাধ। কল লগ, ভয়েস রেকর্ড, হুমকির বার্তা—সবই আদালতের সামনে উপস্থাপিত করা আছে।”
কোর্টরুমে আবারও চাপা ফিসফাস। বিচারক তাঁর হাতুড়ি ঠুকে সবাইকে চুপ করালেন। তিনি বলেন: “আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনেছে। তদন্ত রিপোর্ট, প্রমাণপত্র ও যুক্তি–তর্ক আমরা পর্যবেক্ষণ করব। পরবর্তী এ রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হবে।”
এরপর আরো দুই আদালত দিবসে দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালতে আবারও ভিড় জমেছে। বিচারক তাঁর রায়ের খসড়া পড়তে শুরু করলেন।
“আদালত সমস্ত প্রমাণ, সাক্ষীর জবানবন্দি ও উভয় পক্ষের যুক্তি পর্যালোচনা করেছে। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা, গোপনে ছবি ও ভিডিও ধারণ করা এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে মানসিক নির্যাতন চালানো, যা সাইবার আইন অনুযায়ী গভীর অপরাধ। দেখা যাচ্ছে, ভিডিওর কিছু অংশ আসামি ও ভিকটিমের সম্মতিতে ধারণ করা হলেও, গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও এবং হুমকির ম্যাসেজ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ বহন করে। আইনের চোখে এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ এবং মানসিক নির্যাতনের শামিল। ডিজিটাল মিডিয়ায় বেআইনি উপায়ে ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ ও ব্যবহার গুরুতর অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ সমাজে একটি নিকৃষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, এবং এমন অপরাধ কঠোর শাস্তি যোগ্য।এই মামলার গুরুত্ব শুধু একজন ব্যক্তির দোষ প্রমাণ নয়, এটি একটি সামাজিক বিষয় যেখানে প্রযুক্তি ও মানবাধিকারের সুরক্ষা জরুরি। বিচার প্রক্রিয়া যথাযথ হয়েছে এবং সকল প্রমাণ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মামলার আলোকে প্রযুক্তির অপব্যবহারের ভয়াবহ বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। একজন তরুণীর আস্থা ও মর্যাদা লাঞ্ছিত হয়েছে, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করা হয়েছে। পেশ করা সমস্ত প্রমাণ, ভিডিও ক্লিপ, সাক্ষীদের বয়ান, এবং তদন্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অভিযুক্ত শান্ত মাহবুব তার কুশীলব কাজের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী।”
তিনি একটু থেমে বললেন, “তাই অভিযুক্ত শান্ত মাহবুবকে দণ্ডবিধি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা (বর্তমান ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) অনুযায়ী অপরাধী সাব্যস্ত করা হলো। তাঁকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হলো। আসামি রায়ে অসন্তুষ্ট হলে উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পাবেন। তবে সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
কোর্টরুমে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা, তারপর চাপা গুঞ্জন। সাংবাদিকরা দৌড়ে বেরিয়ে খবর পাঠাতে শুরু করলেন।
সিথী চোখ ভিজে উঠলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। সে জানত, এ রায় শুধু তার জন্য নয়, বরং অনেক নীরব নারীর জন্যও সাহসের প্রতীক হয়ে থাকবে।
সিথী, যার চোখে ঝাপসা আনন্দ ও মুক্তির অশ্রু, ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললো.
“আজ আমার জীবনের এক দীর্ঘ যুদ্ধের শেষ। ধন্যবাদ ন্যায়বিচারক এবং পুলিশ বিভাগের কাছে, যারা আমার পাশে থেকেছেন এবং সেই সাথে আপনাদেরকে ধন্যবাদ যারা আমার জন্য দোয়া করেছেন ও সাহস যোগিয়েছেন।”
আদালতের গেট থেকে বেরিয়ে নতুন জীবনের পথে হাঁটলেন সিথী। যেখানে অতীতের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে যাবেন নতুন আত্মবিশ্বাসে।এই রায় শুধু এক ব্যক্তির বিচার নয়, বরং সমাজে নারীর অধিকার ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার এক শক্তিশালী বার্তা। আমাদের জন্য এই মামলাটি শুধু বিচার নয়, দেশের সামাজিক অন্ধকার দূর করার লড়াই।”
সিথী আদালতের সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় চারদিকের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলতে থাকে। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন?”
সিথী হেসে, চোখে অশ্রু নিয়ে বললেন “এটা শুধু আমার বিজয় নয়, প্রতিটি নারীর বিজয়, যারা চুপ থেকে কাঁদে, অথচ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।”
আদালত প্রাঙ্গন থেকে ঘণ্টা খানেক পর নোয়াখালী শহরের এক ছোট ক্যাফের ভেতরে বসে আছে সিথী ও তার পরিচিত সাংবাদিক দিনার খান।। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, ছাদের টিনে টুপটাপ শব্দ। ক্যাফের এক কোণে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, আলো। তিনটি শীর্ষ টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি এসে গেছে তার সাক্ষাৎকার নিতে।
প্রথম প্রশ্ন করল এক তরুণ সাংবাদিক, ‘’আপনি কি মনে করেন, শান্ত মাহবুবের সাজা আপনার জীবনের জন্য যথেষ্ট ন্যায়বিচার এনেছে?”
সিথী হালকা হাসি দিল, তারপর ধীরে বললো, “ন্যায়বিচার শুধু সাজায় সীমাবদ্ধ নয়। আজকের রায় আমাদের মতো নারীদের জন্য এক বার্তা, কেউ যদি আপনাকে ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে চায়, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। আমি ভয় পেয়েছিলাম, হ্যাঁ… কিন্তু ভয়কে সঙ্গী করে বেঁচে থাকার চেয়ে একবার লড়ে হেরে যাওয়া ভালো।”
আরেক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখন কী করবেন?”
সিথীর চোখে হালকা দৃঢ়তার ঝিলিক, “আমি আবার আমার নার্সিং পেশায় এখনো আছি। কিন্তু শুধু হাসপাতালে নয়, এখন আমি সাইবার ক্রাইম ভিকটিম সাপোর্ট গ্রুপে কাজ করতে আগ্রহী। আমি চাই, আমার মতো কেউ যেন এভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার না হয়।‘’
ক্যামেরার লাল লাইট জ্বলতে থাকে, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সিথীর এই সাহসীকতার গল্প। অনেকে কমেন্টে লিখছে—
“আপনি আমাদের অনুপ্রেরণা।”
“আপনার জন্য অন্য মেয়েরা আরও সাহসী হবে।”
‘’এ যুদ্ধে আপনি একা জিতেন নি, নারীজাতি জিতেছে।‘’
দুই মাস পর, ঢাকার একটি সাইবার সচেতনতা সেমিনারে সিথী অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে বলছে, “আমাদের নীরবতা অপরাধীদের সাহসী করে তোলে। তাই, কথা বলুন, প্রমাণ রাখুন, আইনের দ্বারস্থ হোন।”
তরুণ-তরুণীদের করতালি ভেসে আসে। সিথী অনুভব করে, জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার গহ্বর থেকে উঠে এসে আজ সে এক আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে, নিজের জন্য ও অন্যদের জন্যও।
সাইবার ক্রাইম সচেতনতা সেমিনারের কয়েকদিন পর, সিথীর নাম ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টিভি সব জায়গায়। তার সাহসী লড়াই, শান্তর সাজা, এবং অন্য নারীদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেশের মানুষকে মুগ্ধ করেছে।
এমন সময়েই এক ফোনকল আসে ফেনীর এক মানবাধিকার সংস্থার নির্বাহীপরিচালক আরিফুল ইসলামের মোবাইল থেকে। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, লম্বা-সুস্থদেহী, গলায় আন্তরিকতার স্বর।
– “আপনার সাক্ষাৎকার দেখেছি। আপনি সত্যিই অসাধারণ সাহসী। আমি চাই, আমাদের সংস্থায় আপনাকে যুক্ত করতে।”
কিছুদিনের যোগাযোগে সিথী বুঝল, আরিফ শুধু মানবাধিকার নিয়েই কাজ করেন না- তিনি নিজের জীবনও এই আদর্শে গড়ে তুলেছেন। গ্রামের নিপীড়িত নারীদের জন্য আইনি সহায়তা, সাইবার অপরাধে ক্ষতিগ্রস্তদের মামলা পরিচালনা, বস্তির শিশুদের শিক্ষা- এসব তার নিত্যদিনের কাজ। এছাড়াও তিনি দু’টি হাসপাতালও পরিচালনা করছেন।
এক বিকেলে নোয়াখালীর ডিসি পার্কের সবুজের ধারে বসে ছিল আরিফ আর সিথী। চারপাশে গাছের পাতার মৃদু দোলায় হাওয়া যেন ভিন্ন এক প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ নীরবতা ভেঙে আরিফ বলে উঠল, “সিথী, জানো? আমি তোমার চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখি। আমি জানি তুমি অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে এতটুকু এসেছ, হয়তো অনেক কিছু হারিয়েছও। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, জীবন কখনোই একবারে থেমে থাকে না। দ্বিতীয়বার নতুন করে গড়ার সুযোগটা সবার প্রাপ্য। তুমি চাইলে… আমি তোমার জীবনের সেই শুরুটা আরো এগিয়ে দিতে পারি।”
কথাগুলো শুনে সিথীর চোখ দুটো কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে স্থির হয়ে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, “আমি ভয় পাই… খুব ভয় পাই। কিন্তু আপনার সাথে কথা বললেই সেই ভয়টা অনেকটা মিলিয়ে যায়। তবে মনে রাখুন, আপনি এখনো আমার ভেতরটা দেখেননি। দেখেছেন শুধু বাইরের রূপ।”
আরিফ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, “ভেতরের গল্পটা জানতে হবে না, সিথী। আমি তোমাকে যেটুকু জানি, সেটাই যথেষ্ট। তুমি একজন সাহসী, প্রতিবাদী নারী। এটাই তোমাকে আলাদা একটা মর্যাদা এনে দিয়েছে।”
আরিফ একটু থেমে হঠাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “শোন, এত কথা বলছ, এবার তোমার পরিচয়টা দাও তো। তোমার পরিবারে কে কে আছে?”
সিথী গভীর শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল, “আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা ছিলেন একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, মা গৃহিণী। দু’জনকেই ২০২০ সালে করোনায় হারিয়েছি—প্রথমে বাবা, তারপর মাত্র পনেরো দিনের ব্যবধানে মা-ও চলে গেলেন। আমার কোনো ভাই-বোন নেই, চাচা-জেঠা বা মামাও নেই। বলতে পারেন, আমি একেবারেই একা। বাবামায়ের মৃত্যুর এক মাস পর হাসপাতালে আমার চাকরি হলো। সেখান থেকেই শুরু আমার নতুন সংগ্রাম।”
আরিফের চোখে গভীর মমতা জমে উঠল। ফিসফিস করে বলল, “তোমার এই একাকিত্ব আমি খুব বুঝতে পারি। কারণ আমিও জানি, শূন্যতা কেমন হয়।”
কিছুক্ষণ নীরবতা ভাসল দুজনের মাঝখানে। তারপর আরিফ আস্তে করে বলল, “আরেকটা কথা বলি সিথী, তোমার যে অধ্যায়টা সবাই ‘কলঙ্ক’ বলে জানে, সেটা আসলে আমার কাছে সাহসের আরেক নাম। আমি মিডিয়ায় সব দেখেছি। সত্যিই তুমি একজন সাহসী নারী। আমি তো ঠিক এমনই কাউকেই খুঁজছিলাম… আর আজ মনে হচ্ছে, সেই মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছি।”
সিথী চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। চারপাশের সবুজ, পাখির ডাক, বাতাসের ছোঁয়া- সব যেন দূরে সরে গেল। শুধু আরিফের কণ্ঠস্বর এখনো কানে বাজছে।
সে ভাবছে- “এতদিন সবাই শুধু আমার কলঙ্কই দেখেছে, আমার ভেতরের ভাঙাচোরা মানুষটাকে কেউ দেখেনি। আমি কতটা একা, কতটা শূন্য—তা কি কখনো কেউ বুঝেছে? অথচ এই মানুষটা… আরিফ… সে বলছে আমাকেই তার আগামী দিনের স্বপ্ন বানাতে চায়। আমি কি সত্যিই আবার নতুন করে শুরু করতে পারব?
আমার অতীত আমাকে প্রতিদিন তাড়া করে, সমাজ আমাকে আঙুল তোলে, দোষারোপ করে। কিন্তু যদি সত্যিই ভালোবাসা নামের এই শক্তিটা আমাকে নতুন জীবন দেয়? যদি আমি তার বুকে মাথা রেখে আবার বাঁচতে শিখি?
আমি কি পারব নিজেকে বিশ্বাস করতে? আরিফকে বিশ্বাস করতে? নাকি আবার ভেঙে পড়ব?”
সিথীর বুকের ভেতর কেমন হাহাকার জেগে উঠল। চোখ ভিজে এলো অজান্তেই। ধীরে ধীরে সে ভাবল- “আমি ভয় পাচ্ছি… কিন্তু এই ভয়টা হয়তো ভালোবাসার ভেতরেই গলে যাবে। হয়তো আরিফ-ই আমার অন্ধকার ভেদ করে আলো দেখাবে।”
আরিফ একটু থেমে চুপচাপ সিথীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত আন্তরিকতা। চারপাশের সব শব্দ যেন থেমে গেল, শুধু তাদের দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দই শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। আরিফ ধীরে, প্রায় ফিসফিস করে বলল, “সিথী… আমি আর লুকাতে পারছি না। আমি তোমাকে চাই—শুধু এই মুহূর্তের জন্য নয়, আগামী প্রতিটি দিনের জন্য। আমি চাই, ভোরের প্রথম আলোয় তুমি আমার পাশে জেগে ওঠো। দিনের ক্লান্তি শেষে তুমি আমার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি চাই, তোমার দুঃখগুলো আমার হৃদয়ে মিশে যাক, তোমার হাসিটা হোক আমার বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ।
হয়তো আমি নিখুঁত নই, হয়তো তোমাকে কোনো রাজপ্রাসাদ দেখাতে পারব না। কিন্তু আমি তোমাকে একটা প্রতিশ্রুতি দিতে পারি—আমার ভেতরে যতটা ভালোবাসা আছে, সবটুকুই তোমার জন্য। আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না, তুমি চাইলে আমার জীবনটাও হয়ে উঠুক তোমার আশ্রয়।”
আরিফের কণ্ঠ কেঁপে উঠল। সে ধীরে সিথীর হাত নিজের হাতে ধরে বলল, “তুমি চাইলে আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো, কিন্তু মনে রেখো, আমি তোমাকে ছাড়া আমার ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারি না। তুমি যদি রাজি থাকো, তবে আমি তোমার জীবনের সেই নতুন জীবন শুরু হতে চাই।”
সিথী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল সবুজ ঘাসের দিকে। চোখের কোণে জমে ওঠা অশ্রু গোপন করতে চাইলেও আর লুকাতে পারল না। ধীরে মাথা তুলল আরিফের দিকে, কণ্ঠটা কেঁপে উঠল, “আরিফ… আমি জানি না তোমাকে বিশ্বাস করতে পারব কি না। আমি জানি না, আমার ভাঙা জীবনের ভার তুমি কতটা নিতে পারবে। আমি ভয় পাই… ভয় পাই আবারও সবকিছু হারানোর। সমাজ আমাকে আজও ক্ষমা করেনি, ভুলেও না। কিন্তু তুমি যখন বলো, তুমি আমার অতীত দেখতে চাও না—শুধু আমাকে দেখতে চাও… তখন মনে হয় হয়তো সত্যিই আমি নতুন করে পথচলা শুরু করতে পারব। তোমার কথা শুনলেই বুকের ভেতর যে অন্ধকার জমে ছিল সেটা একটু একটু করে সরে যাবে।
আরিফ সিথীর হাতটা তার বুকে চেপে রেখে বলল, ‘’আমার প্রতি আস্থা রাখ, প্লিজ!
-আরিফ, আমি জানি না সামনে কী অপেক্ষায় আছে। তবে আজ প্রথমবার মনে হচ্ছে, আমি হয়তো একা নই। হয়তো আপনি থাকলে আমি আবারও নিজের ভেতরের ভাঙা টুকরোগুলো জোড়া দিতে পারব।”
বলতে বলতে সিথীর গলা আটকে গেল। তার চোখ ভিজে উঠল, ঠোঁটে একটুখানি কাঁপা হাসি ফুটল—যেন ভয়ের ভেতর থেকেও নতুন আশা জন্ম নিচ্ছে।
আরিফ ধীরে হাত বাড়িয়ে সিথীর হাত নিজের হাতে নিল। তার কণ্ঠ দৃঢ়, অথচ কোমল, “সিথী, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- তোমার অতীত নিয়ে আমি কোনোদিন প্রশ্ন করব না। তুমি যেমন আছ, যেমন ভেঙে গিয়েছ, যেমন আবার গড়ে উঠছ এর সবটুকুই আমি মেনে নেব। তোমাকে একা চলতে হবে না, আমি তোমার পাশে থাকব। যত ঝড়ই আসুক না কেন, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
আরিফের কথাগুলো সিথীর বুকের গভীরে ঢুকে গেল। এতদিনের দ্বিধা, ভয় আর লজ্জার দেয়াল যেন হঠাৎ ভেঙে পড়ল। চোখ ভিজে এল, ঠোঁট কাঁপল। ধীরে সে মাথা নেড়ে সায় দিল, “হ্যাঁ, আরিফ… আমি রাজি। আমি চাই আবারও বাঁচতে, তোমার সাথে জীবন গড়তে।”
দু’জনের চোখে চোখ রাখল, আর সেই মুহূর্তে চারপাশের ভিড়, কোলাহল সব যেন হারিয়ে গেল।
এরপর তারা সুপার মার্কেটে এক ছোট্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকল। টেবিলে বসে ফ্রাইড রাইস, চিকেন চিলি আর স্যুপ অর্ডার দিল। খাওয়ার সময়ও দু’জনের চোখে চোখে মৃদু হাসি লেগেই থাকল। মাঝে মাঝে কোনো কথা না বলেও তারা যেন অনেক কিছু চোখের দৃষ্টিতে বুঝে নিচ্ছিল।
নাস্তার পর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়াল। সিথীকে বিদায় জানাতে আরিফ কিছুক্ষণ দ্বিধা করল, যেন সময়টাকে আরেকটু দীর্ঘ করতে চায়। অবশেষে গাড়ির দরজা খুলে ওঠার আগে আবারও সিথীর হাত চেপে ধরল, “আমি শিগগিরই ফিরব। তুমি একা নও, এটা মনে রেখো।”
সিথী নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিল। গাড়ি স্টার্ট হল, ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল ফেনীর পথে। সিথী দাঁড়িয়ে রইল, চোখের সামনে গাড়িটা যতক্ষণ না অদৃশ্য হলো। বুকের ভেতর ভয়ের সাথে সাথে এবার এক অচেনা শান্তি আর আশার স্রোত বইতে লাগল।
গাড়ি চলে যাওয়ার পর সিথী রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুক কেঁপে উঠছিল। ভয়, উত্তেজনা, আশা, আর অজানা এক শান্তি সব মিশে একাকার। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতরের অন্ধকার হৃদয়ে আবারও আলো ঢুকেছে।
সে নিজে ভাবল, “আরিফ… সে শুধু কথায় নয়, আচরণেও অমায়িক। আমি তার পাশে থাকলে হয়তো আমার ভাঙা জীবন আবার নতুন রঙ পেতে পারে। আমার ভয়, অন্ধকার, একাকিত্ব- সব মিলিয়ে হয়তো এবার আমি বাঁচতে পারব। আরিফ আমার হাতে হাত রেখে বলল, ‘আমি ছাড়ব না।’ কি আশ্চর্য! এমন মানুষ কি সত্যিই হয়?
হয়তো এটাই দ্বিতীয় সুযোগ- নতুন জীবন, নতুন আশা, নতুন প্রেম। আমার ভেতরের সমস্ত শূন্যতা ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠছে। আমি জানি, পথ সহজ হবে না। কিন্তু আরিফের সাথে আমি সেই পথ পাড়ি দিতে পারব। এবার ভয় আর কষ্ট একা ভোগ করতে হবে না।”
শীতল হাওয়ায় তার চোখে ঝলমল করে উঠল অশ্রু আর ঠোঁটে ফুটল হালকা হাসি, ভয় আর আশা একসাথে মিশে এক নতুন দিনের সূচনা ঘটাচ্ছিল।
সিথী বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে স্মৃতির আড়ালে ফিরে এল আরিফের সঙ্গে শেষ দুই-তিন দিনের কথোপকথন। মনে পড়ছে তার হাসি, কণ্ঠের কোমলতা, সেই অদ্ভুত আন্তরিকতা যা তিন দিনের আলাপে মনকে ছুঁয়ে গেছে।
“এই ছেলেটা সত্যিই ভালো, অমায়িক ও নারীবান্ধব… কিন্তু আমি তো এখনও ওকে পুরোপুরি চিনি না। আমি ওকে নিজের জীবনের অংশ বানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। অথচ শান্তও তো ঠিক এমন মৃদু ব্যবহার আর কোমল কথায় আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল। তখন আমি কত সহজেই ফাঁদে পড়ে জীবনটাকে কলঙ্কিত করে দিয়েছিলাম… আর আজও তার সেই অসভ্য ছায়া ভেতরে টলটল করে।”
সিথীর বুকের ভেতর অদ্ভুত এক মিশ্র অনুভূতি: উত্তেজনা, ভয়, আর একটু আশা, সবই একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে নিজেকে নিয়ে ভাবল- আমি পথহারা, একা। জীবন থেমে থাকবে না। নতুন করে সঙ্গী খুঁজে, নতুনভাবে শুরু করতে হবে। কিন্তু আগে… আমাকে ওকে ভালোভাবে জানতে হবে। বয়স তো প্রায় ৩৫। এতদিন কেন বিয়ে করেনি সে? এসব তথ্য বের করতে হবে অন্য কোনো মাধ্যমে। আমি চাই, যেন ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক যেন পুরোপুরি সঠিকভাবে হয়।
হয়তো এই দ্বিধা, এই সতর্কতা আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে। এবার আমার জীবন হবে প্রকৃত ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ও নি:র্ভুল- আরিফের সঙ্গে হোক বা না হোক।”
সিথী চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করার আগে আরিফকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, তারপরই আমাকে আগাতে হবে। মানুষ যেথায় ধাক্কা খায় সেথায় তাকে শিক্ষা নিতে হয়।
পরের দিন সকালে সিথী ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নেয় আরিফের অতীত, পরিচয়, স্বভাব সবই খবর নিতে হবে। শুধু আরিফের মুখ থেকে নয়, ভিন্ন সূত্র থেকেও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
সে প্রথমেই নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলল। ধীরে ধীরে জানা গেল, আরিফের জীবনসংক্রান্ত কিছু তথ্য- যেমন তার পরিবার, কাজের ধরন, বন্ধু, এবং তার ব্যক্তিগত পছন্দ—সবই অজানা। সিথী বুঝছে, আরিফকে সরাসরি প্রশ্ন করে এসব জানা যাবে না; তাই অন্যভাবে জানতে হবে।
পরদিন সকালে অনুসন্ধানী মন নিয়ে কালো হিজাব পরে একাই রওনা দিল ফেনীর পথে। শহরে পৌঁছে একটি রিকশা ধরে সোজা চলে গেল আরিফের অফিসের সামনে। ভেতরে ঢুকে নিজেকে পরিচয় দিল নির্যাতিত নারী হিসেবে। রিসেপশনে ভুয়া নাম পরিচয় দিয়ে নিবন্ধন করে তাকে ওয়েটিং রুমে বসতে বলা হলো। সেখানে আগে থেকেই চারজন নারী বসে আছে। জানানো হলো—তার ডাক পড়বে তাদের পরেই।
কিন্তু সিথীর মনে বিরাজ করছিল অস্থিরতা। সে তো নির্যাতিত নয়, আর ডাক পড়লে ভেতরে গিয়ে কী বলবে? আসলে তার উদ্দেশ্য আরিফ সম্পর্কে জানা—কিন্তু সেটা এখান থেকে কীভাবে সম্ভব?
এই ভাবনার মধ্যে হঠাৎ তার চোখ পড়ল অফিসের মহিলা পিয়নের দিকে। ছোট্ট একটি রুমে বসে তিনি চায়ের কাপ ধুচ্ছেন। পাশে টুলে বসে খেলা করছে প্রায় পাঁচ বছরের একটি মেয়ে। সিথী এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল, নাম জিজ্ঞেস করল। আদরে ভরিয়ে বলল, “তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছ। আমার বোনের মেয়েটির সঙ্গেও তোমার অনেক মিল।”
কথা বলতে বলতে সিথী মেয়েটির হাতে একশ টাকার নোট দিয়ে বলল, “ও যা খেতে চায় কিনে দিয়েন।” হঠাৎ এমন ব্যবহার পেয়ে পিয়ন খুশিতে অভিভূত হয়ে পড়ল। চোখ ভিজে উঠল কৃতজ্ঞতায়। সিথীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি এ অফিসে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছি। কিন্তু এমন সহানুভূতি কোনোদিন কেউ দেখায় নি।”
সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সিথী মৃদু স্বরে বলল, “খালা, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমি আপনাদের সংস্থার সাহায্যে স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকদের শায়েস্তা করতে পারি।”
পিয়ন আবেগ নিয়ে বলল, “আমাদের বড় সাহেব খুবই ভালো মানুষ। নিজ খরচে অসংখ্য অসহায় নারীকে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। শত শত মা-বোন বিচার পেয়ে তাকে দোয়া করেছেন।”
সিথী ধীরে ধীরে মূল প্রসঙ্গে এল, “আপনাদের বড় সাহেবের নাম কী?”
-আরিফুল ইসলাম। তিনি খুব ধনী। এই অফিস ছাড়াও তার আরও দুটি হাসপাতাল আছে। সেখানে গরিব মানুষদের বিনা খরচে চিকিৎসা করান।
সিথীর বুক কেঁপে উঠল। তবু শান্ত গলায় আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যারের পরিবার?”
পিয়নের মুখ ভারী হয়ে গেল, “দুই বছর আগে স্যারের স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। একটি দুর্ঘটনায় মা ও সন্তান দুজনেই মারা যান। তারপর থেকে স্যার আর বিয়ে করেননি। তিনি নাকি তার স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন।”
সিথীর বুকের ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল। সে চুপ করে আরও শুনতে লাগল।
-স্যার এখন অফিসে আছেন?
-না, আজ আসেননি। হয়তো বাইরে গেছেন। উনি সাধারণত দোতলায় বসেন।
-বাসায় কারা থাকেন?
-কেউ না। স্যারের মা-বাবাও মারা গেছেন। একা থাকেন। তবে রান্নার জন্য একজন পুরুষ বাবুর্চি আছে। সে দেখাশুনা করেন।
দূরে মসজিদের আছরের আজান ভেসে আসল। ঘরির দিকে তাকিয়ে বুয়ার রুম থেকে বের হয়ে যায়। ওয়েটিং রুমে আর ফিরে যায় নি। রিকশার অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়ালেন। সিথীর বুকের ভেতর কেমন এক চাপা ঝড় বইতে লাগল। আরিফের নাম, তার স্ত্রী-সন্তান হারানোর গল্প, একাকীত্ব—সবকিছু শুনে সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না।
রিকশায় উঠলেন বাস ধরার উদ্দেশ্যে। রিকশায় বসে সিথী মনে মনে ভাবছে- এই মানুষটা আমার সামনে কেন এল? ভাগ্য কি সত্যিই আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে চাইছে? আরিফ হয়তো নিছক ভালো মানুষ, হয়তো তার জীবনে এখনও খালি জায়গা আছে। কিন্তু আমি কি সেই জায়গাটা পূরণ করতে পারব? আমি তো নিজের অতীত নিয়েই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। শান্ত আমাকে যেমন প্রতারণা করেছিল, তেমনি আরেকটি ফাঁদে পড়ে যাব না তো?
সোনাপরগামী বাস ধরলেন সিথী। সিটে বসে তার চোখ ভিজে উঠল। মনে মনে আবারও বলল, “আরিফের বিষয়ে যেটুকু জেনেছে তাতে মনে হচ্ছে—ওর বুকেও কষ্টের পাহাড় জমে আছে। একা মানুষ, তবুও অসহায় নারী ও অসুস্থ গরীব মানুষদের জন্য লড়ে যাচ্ছে। হয়তো আমিও একা, আমার ভেতরেও কলঙ্কের ক্ষতচিহ্ন আছে। কলঙ্কিত নারীকে আরিফের বন্ধু.আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনরা কোন দৃষ্টিতে দেখবে? আমি কি তার সন্মানহানির কারণ হব না তো? সে তো সেই দিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- তোমার অতীত নিয়ে আমি কোনোদিন প্রশ্ন করব না। তুমি যেমন আছ, যেমন ভেঙে গিয়েছ, যেমন আবার গড়ে উঠছ এর সবটুকুই আমি মেনে নেব। তোমাকে একা চলতে হবে না, আমি তোমার পাশে থাকব। যত ঝড়ই আসুক না কেন, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না।
কিছুদিন পর সিথী তার পরিচিত সাংবাদিক দিনার খানকে ফোন করে তার অফিস কক্ষে আসতে অনুরোধ করে। দিনার খান তার হোন্ডা নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে আসেন। তাদের দু’জনের আলাপের একপর্যায়ে দিনার খান বললো, ‘’আমি আরিফ নামে কাউকে চিনি না। তবে আমার সহযোদ্ধা সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম হারুন চিনতে পারে। সে ফেনী শহরেই বিয়ে করেছেন। বেশ সময় ধরে তিনি ফেনীতে কাটিয়েছেন।‘’
-তাহলে উনাকে এখানে আসতে বলুন, বললে উনি এখানে আসবেন কি না?
-ঠিক আছে, উনি না আসতে পারলে মোবাইলে কথা বলে জেনে নেব।
-হ্যাঁ, সেটাও করা যায়। আপনি তাহলে উনাকে এখনিই কল দেন। তবে লাউডস্পীকার দিয়ে কথা বলুন।
চায়র সাথে বিস্কুট খেতে খেতে দিনার বললেন, হ্যালো হারুন সাহেব, আপনি এখন কোথায়?
-আমি শহরেই আছি। কেন? কিছু বলবেন?
-দ্রুত গ্রীন কেয়ার হাসপাতালে ২০৮ নম্বর রুমে আসতে পারবেন?
লাউডস্পীকারে সিথী সবই শুনছেন।
-না, এক্ষুনি আমাকে একটা কনফারেন্সে যেতে হবে। কী জন্য তা মোবাইলে বলেন।
-আপনি ফেনী শহরের মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব আরিফুল ইসলামকে চেনেন?
-হঠাৎ এ লোককে জানার জন্য এত ব্যস্ত কেন? কোথাও অনিয়ম অঘটন ঘটিয়েছে না-কি?
-না এমনিতে জানতে চেয়েছি।
-উনার বাসা ফেনী ডিটি রোডে। বিশাল ধনী। যেমন ফর্সা তেমন লম্বা, ব্যবহার খুবই মিষ্টি ও অমায়িক। দুই বছর আগে উনার ওয়াইফ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখনো বিয়ে করেন নি এটা জানি। পাঁচ-ছয় মাসের ভেতর বিয়ে করেছেন কিনা সেটা হয়তো জেনে নিতে পারবো। কার জন্য এত খবর নেওয়া?
-না, ওইসব কিছুই না। আমার এক আত্মীয় আরিফ সাহেবকে নিয়ে বেশ গর্ব করছেন, তাই জানতে চেয়েছি।
-হ্যাঁ, উনাকে নিয়ে গর্ব করাটা অস্বাভাবিক কিছু না। উনি ফেনীর ধনীদের মধ্যে একজন এবং খুবই ভদ্র লোক। উনি একটা এনজিও’র নির্বাহী পরিচালক, ফেনীতে তার নিজস্ব দু’টি হাসপাতাল আছে, একটি বড় মার্কেট আছে। আরো বলছি – উনার বড় ভাই সুজারল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা ও সেখানকার একটি বিখ্যাত মানবাধিকার সংস্থার বড় একটি পদে জব করছেন।
-ঠিক আছে, আর বলা লাগবে না।
-কেন লাগবে না, জানতে যখন চেয়েছেন তখন তার সবই জানতে হয়। উনার আরেক ভাই বর্তমানে একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ভাবি যুগ্ম সচিব। আরিফ সাহেব আগামীতে বড় একটি দল থেকে এমপি পদে প্রার্থী হতে পারেন। তবে তিনি রাজি হচ্ছেন না, জনগণ চাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের সবসময় মিথ্যা বলতে হয়, তিনি মিথ্যা বলা পছন্দ করেন না।
-ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। এখন রাখি।
মোবাইল অফ করে দিনার বললো, সবই তো শুনলেন। এবার আরিফ সাহেবের বিষয়টা খুলে বলুন।
-তেমন কিছুই না। উনি আমাকে তার জীবনসঙ্গী করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তাই ভাবছি উনার সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। আমি অন্যভাবেও কিছুটা তথ্য পেয়েছি। হারুন সাহেবের বলা তথ্যের সাথে অনেকটা মিল রয়েছে।
দিনার কপালে চোখ তুলে বললেন, সম্পর্কটা খারাপ হবে না। আপনি বললে আমি হারুন সাহেবকে সাথে নিয়ে বিয়ের ব্যাপারে আরিফ সাহেবের সাথে দেখা করতে পারি এবং দিনক্ষণও ফাইনাল করতে পারি।
-হ্যাঁ , তাই করেন। কারণ আমার তো নিজস্ব কোন লোক নেই। তবে একটা অনুরোধ থাকবে বিষয়টা যেন কেউ না শুনে।
পনের দিন পর ছোট পরিসরে এক অনুষ্ঠানে, পরিবারের কিছু সদস্য, সহকর্মী ও কয়েকজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে দিনার খানের বাসায় সিথী ও আরিফের বিয়ে হয়।
গোলাপের পাপড়ি উড়ছে, সিথীর মুখে হাসি, এবার আর সেই হাসির আড়ালে লুকানো কোনো ভয় নেই।
বিয়ের কয়েক দিন পর সিথী নার্সের চাকরি ছেড়ে দেয়।, সিথী ও আরিফ ফেনীতে একসাথে মানবাধিকার সংস্থার বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ শুরু করল। গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারীদের সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিপীড়নের শিকারদের আইনি সহায়তা, এবং স্কুল-কলেজে সচেতনতা কর্মসূচি, সব জায়গায় তারা একসাথে কাজ করছে। যে নারীদের মামলা করার সামর্থ নেই তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ১৬টি ধর্ষণ, ৭টি নারী নির্যাতন ও ২টি এসিড মামলার সম্পূর্ণ খরচ ও আইনী সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি দেড়শতাধিক মামলায় শুধু আইনি সহায়তা দিয়ে মানুষের চোখে তারা হয়ে উঠল “সাহসী দম্পতি”।
তাদের কাজের সাফল্যে গণমাধ্যমে আবারও সংবাদ হলো, “সাইবার অপরাধের শিকার থেকে যোদ্ধা, সিথী এখন ২০০ নারীর পাশে।
কিন্তু এই খবরের কাটিং একদিন পৌঁছে গেল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সেলের ভেতরে, শান্তর হাতে।
পত্রিকাটি মুঠোয় চেপে ধরে শান্ত দাঁতে দাঁত কামড়িয়ে বললো, “আমার হাতে আবার ধরা পড়লে, এবার শুধু ছবি নয়, জীবনটাই শেষ করে দেব।”
কারাগারের ভেতরে তার সাথে যোগাযোগ ছিল এক সাবেক সহযোগীর । তার মাধ্যমে, যে এখনো কারাগারের বাইরে সক্রিয়. সেই সহযোগীকে শান্ত নির্দেশ দিল, “ওদের সামাজিক সুনাম নষ্ট করো। অনলাইনে ভুয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়ে কেলেঙ্কারির খবর ছড়িয়ে দাও। কিছু পুরনো ছবি আছে,, সেগুলো ফাঁস করো।”
এদিকে সিথী ও আরিফ তাদের নতুন প্রজেক্টের কাজে কুমিল্লায় যাচ্ছিল। পথে এক সাংবাদিক ফোন করে জানাল, “আপনাদের বিরুদ্ধে অনলাইনে কিছু অপপ্রচার শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনারা ট্রেন্ডিং। সতর্ক থাকুন।”
সেদিন রাতেই তারা বুঝল, শান্ত এখনো থেমে নেই।
আরিফ গম্ভীরভাবে বললো, “মনে হচ্ছে, এবার লড়াইটা শুধু আইনের নয়, অনলাইন যুদ্ধও।”
সিথী দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বললো, “আমি ভয় পাব না। যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, কেউ আর কোনো নারীর জীবন নষ্ট করতে পারবে না। তুমি শুধু চিরদিন আমার পাশে থাকবে।”
পরদিন সকালে কুমিল্লার একটি বালিকা স্কুল ও দুটি মহিলা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মশালায় সিথী দাঁড়িয়ে বলছিল,
“ইন্টারনেট হলো জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার, আবার একই সাথে বিপদেরও এক অন্ধকার পথ। মনে রেখো, ইন্টারনেটের গতি যেমন তীব্র, আইনের গতি কিন্তু অনেক ধীর। তাই নিজের সম্মান, নিজের মর্যাদা কখনও কারও হাতে তুলে দেবে না।
যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, ভয় পেও না—চুপ থেকো না। সাহস নিয়ে সাহায্য চাইবে। আমি আছি তোমাদের পাশে। তোমাদের সবার কাছে আমার নম্বর থাকবে—খবর পেলেই আমি ছুটে আসব।
মনে রেখো, যারা ভয়ে চুপ করে থাকে, তারা নারী জাতির জন্য এক একটি ক্ষত হয়ে দাঁড়ায়। তাদের নীরবতায় দানবেরা আরো শক্তিশালী হয়, আরো ভয়ংকর হয়। তারা বারবার অঘটন ঘটায় আর দাঁত কেলিয়ে হাসে। সেই নরপিশাচদের হাসি থামাতে হবে।
যেখানে নারী ধর্ষণ, নির্যাতন বা অধিকার হরণ হবে, সেখানে আমরা যদি একসাথে বা একাকী প্রতিরোধ করি এবং আইনের আওতায় তাদের আনতে পারি, তাহলে সমাজ থেকে একদিন সেই দানবদের চিরতরে বিদায় জানানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, নারীর প্রতি সহিংসতা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম যে দেশগুলোতে, সেগুলো হলো—আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রিয়া। কোনো দেশেই সহিংসতা একেবারে নেই—কিন্তু এসব দেশে আইন অত্যন্ত কঠোর, নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা প্রবল এবং বিচারব্যবস্থা কার্যকর। তাই সেখানে নির্যাতনের হার প্রায় শূন্যের কোঠায়।
আমরাও পারব, যদি আমরা সচেতন হই, প্রতিবাদী হই, লজ্জা না পেয়ে আইনের আশ্রয় নেই। শুধু নারীদের প্রতিবাদে নয়, রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে। আইন ও বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে। সেই পরিবর্তনের দাবিতে আমরা কয়েকটি সংগঠন একসাথে উদ্যোগ নিয়েছি। শীঘ্রই আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে আমাদের দাবি পেশ করবো।
তোমাদের বয়স যদি ১৮ বছরের বেশি হয়, আর পরিবার থেকেও যদি ঝামেলার শিকার হও, তখনও আমাকে ফোন করবে, আমি পরামর্শ দেব, পাশে থাকব।
তাই বলছি, আমার মোবাইল নম্বরটা তোমরা সংরক্ষণ করে রাখো। মনে রেখো, নীরবতা কোনো সমাধান নয়। প্রতিবাদই হলো মুক্তির পথ।”
ছাত্রীদের চোখে উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছিল। ছাত্রীরা সিথী ম্যাডামের মোবাইল নং লিখে নেয়।
কুমিল্লার বালিকা স্কুল ও দুটি মহিলা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মশালার মাত্র বিশ দিন পর, একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর সিথীকে স্তব্ধ করে দিল। শিরোনামে লেখা, “বাড়িওয়ালা কর্তৃক বুয়া ধর্ষণ, ২০ হাজার টাকায় দফারফা”।
খবরটি পড়ে সিথী আর আরিফ কোনো দেরি না করে ঢাকা থেকে ছুটে গেল হবিগঞ্জের সেই ধর্ষিতার বাড়িতে। গ্রামটি সিথীর কাছে একেবারেই অচেনা। সরু কাঁচা রাস্তা, চারপাশে ধানক্ষেত, আর মাটির ঘরের আঙিনায় জড়ো হওয়া মানুষের ভিড়। ঠিক মাঝখানে বাঁশের মোড়া পেতে বসে আছেন গ্রামের মাতব্বররা। তাদের সামনে কাঁদতে কাঁদতে মাথা নিচু করে বসে আছে সেই গৃহকর্মী কিশোরী।
সিথী প্রথমে কিছুটা অচেনা পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করলেও, মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরে ঝড় বইতে লাগল। এত অল্প বয়সেই যে এভাবে ভেঙে পড়তে হয়, তা সে সহ্য করতে পারল না।
গ্রামের মাতব্বর আর আত্মীয়-স্বজনরা বোঝাচ্ছে, “২০ হাজার টাকা তো অনেক। মেয়ে মানুষ যদি মামলা করে, সমাজে মুখ দেখাবে কীভাবে?”
সিথী রাগে কাঁপছিল। সে মেয়েটির হাত ধরে বলল, “তুমি টাকা নিলে তোমার ক্ষত সারবে না। তোমার নীরবতা ওই নরপিশাচকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। আজ তুমি চুপ করলে, কাল সে অন্য আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবে। মামলা না করলে এই অন্যায়ের বিচার হবে না।”
কিন্তু মেয়েটির চোখে তখন শুধুই ভয়। সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “কিন্তু আপা, আমি মামলা করুম তাইলে আমার বুয়াগিরি থাকবো না। আমার ঘর-পরিবার খাইবো কি দিয়া?”
আরিফ পাশে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। সিথীর চোখে তখন ক্রোধ আর বেদনার ঝড় একসাথে। সে বুঝল, কেবল আইনের কথা বললেই হবে না—মানুষের মন থেকে ভয় দূর না করা পর্যন্ত প্রকৃত পরিবর্তন আসবে না।
মাতব্বররা গম্ভীর হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাল। কারও চোখে অনুশোচনা, কারও চোখে রাগ। একজন উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘এ যে মহিলা কে আপনি? কেন আপনি মেয়েটিকে কুপরামর্শ দিচ্ছেন?
সিথী গভীর শ্বাস নিয়ে লোকটির চোখের দিকে তাকাল। চারপাশে উপস্থিত মাতব্বর, আত্মীয়-স্বজনদের সামনে সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“মেয়ে মানুষ মুখ দেখাবে কীভাবে- এই প্রশ্নটা কেউ করব না। বরং বলবে, ধর্ষকটা এখন মুখ দেখাবে কীভাবে? আমি সেই ব্যবস্থা করে ছাড়ব। যে তোমাদের গ্রামের মাটিকে কলুষিত করেছে, যে নরপিশাচ মেয়েদের ইজ্জতকে নিজের খেলনা ভেবেছে, সেই লোকটিকে লুকিয়ে তোমরা কাকে রক্ষা করছ? আজ যদি তোমাদের ঘরের মেয়ের সঙ্গে এমন হতো, তখনও কি দফারফা করে টাকা নিয়ে চুপ থাকতে পারতে?”
মেয়েটি ফিসফিস করে আবারও বললো, “আপা, আমি মামলা করুম তাইলে আমার বুয়াগিরি থাকবো না। আমার ঘর-পরিবার খাইবো কি দিয়া?”
সিথী তার হাত শক্ত করে ধরল, “তুমি একা নও। আমি আছি, আমরা আছি। টাকা যদি দরকার হয়, আমি দেব। কিন্তু তোমার নীরবতায় ওই জানোয়ারটা বাঁচবে, আর কালকে অন্য মেয়েকে ধ্বংস করবে। তুমি যদি সাহস নিয়ে দাঁড়াও, তাহলে হাজারো মেয়ের জন্য তুমি দৃষ্টান্ত হবে।”
সে মেয়েটির হাত ছেড়ে দ্রুত মাতব্বরদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাতব্বরদের চোখে তখন হঠাৎ এক অচেনা আতঙ্ক। কেউ হয়তো টিভি বা খবরের কাগজে সিথীর নাম আগে শুনেছে, কেউ হয়তো ফেসবুকে দেখেছে তার প্রতিবাদী ভঙ্গি। মুহূর্তের মধ্যেই ফিসফাস শুরু হলো,
“ওই না সেই মাইয়া, সাইবার নিরাপত্তা লইয়া কাজ করে…”
“হ, ওই না সেই সিথী, যার নাম আইজকা সারা দ্যাশে হইছে?”
‘’এমন সাহসী মেয়ে না হলে অপরিচিত জায়গায় কেউ আসে?’’
সিথীর পরিচয় মজলিশে ছড়িয়ে পড়তেই মাতব্বররা আর আগের মতো কর্তৃত্ব দেখাতে পারল না। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেল না, বরং অপ্রস্তুত হয়ে চুপচাপ বসে রইল।
সিথী তখন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “মেয়েটির সম্মানকে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেবেন আপনারা? ন্যায়বিচারকে যদি দমন করা হয়, তবে এর ফল ভয়াবহ হবে। আজকের এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিলে আগামীকাল আপনাদের ঘরের মেয়েরাও নিরাপদ থাকবে না।”
তার চোখেমুখের আগুনে যেন মুহূর্তেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গ্রামের মানুষজন একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল, কিন্তু কেউ একটি শব্দও উচ্চারণ করল না।
মেয়েটির চোখে তখন প্রথমবারের মতো আলো ঝলক দিল। সে ধীরে ধীরে সিথীর হাত ধরে ফিসফিস করে বললো, “আপা, মামলা করুম… কিন্তু আপনে আমার পাশে থাকমু তো?”
সিথী হাসল, যদিও তার চোখ ভিজে উঠেছিল। দৃঢ় স্বরে সে বলল—
“আমি শুধু পাশে থাকব না, তোমার হয়ে লড়বও। ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি হাল ছাড়ব না। পুলিশ সুপার ও ডিসি সাহেবকে বলে আজ থেকে তোমাকে আমি সেইফ কাস্টোডিতে রাখার ব্যবস্থা করে দেব।”
সেদিন অচেনা গ্রামের মাঝে দাঁড়িয়ে সিথী একাই হয়ে উঠল শত নারীর কণ্ঠস্বর। আর মাতব্বররা- যারা প্রতিদিন অভ্যাসবশে অন্যায়ের বিচার করত, তাদের আর সেদিন কথা বলার সাহস হলো না।
আরিফ পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে সমর্থন করল। সে মেয়েটিকে বললো, “দেখো, ভয়কে যদি ভেতরে পুষে রাখো, তাহলে সে ভয় একদিন দানবে রূপ নেবে। আজ আমরা যদি সাহস না করি, তাহলে এই সমাজ কখনও বদলাবে না।”
চারপাশে গুঞ্জন উঠল। কিছু তরুণ ছেলেমেয়ে যারা ঘটনাটি দেখতে এসেছিল, তারাও বলতে শুরু করল,
“হ, মামলা হওন দরকার, না হইলে এডার সাহস আরো বাড়ি যাবি।”
‘’এদেরকে ছাড়লে চলবো না, এ লোকটা দুইডা মেয়ের জীবন আগেই নষ্ট করেছে।”
ধীরে ধীরে মেয়েটির চোখে ভয়ের সাথে একরাশ সাহসের ঝলক ফুটে উঠল। সে সিথীর হাত চেপে ধরে বললো, “আইজ ঠিক আছে আপা, মামলা করুম। কিন্তু আপনে আমার পাশে থাকমু তো?”
সিথীর চোখ ভিজে উঠল। সে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমি শুধু পাশে থাকব না, তোমার জন্য লড়ব। ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত পিছু হটব না।”
গ্রাম্য মাতব্বররা তখন আর কিছু বলতে পারল না। সবার চোখের সামনে এক অসহায় কিশোরী তার ভয় ভেঙে সাহসের পথে প্রথম পা বাড়াল।
আর সেদিন সিথী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, “এ লড়াই শুধু এক মেয়ের জন্য নয়, এ লড়াই সব মেয়েদের জন্য। এই সমাজের প্রতিটি দানবকে চিহ্নিত করে তাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।”
মেয়েটি সাহস করে সম্মতি দেওয়ার পর আর দেরি করল না সিথী। সে আর আরিফ মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে স্থানীয় এক আইনজীবীর চেম্বারে গিয়ে বসে। উকিল প্রথমে অবাক হয়ে তাকালেন তারপর বললেন, “আপনারা বাইরে থেকে এসেছেন? এত বড় ঝুঁকি নিলেন কীভাবে?”
সিথী শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “ঝুঁকি না নিলে অন্যায়ের বিচার কখনও হয় না। আমরা মামলা করব- এটা আর কোনো আপোষ নয়।”
আইনজীবী কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। মেয়েটির কান্নাজড়ানো কণ্ঠে ঘটনার বর্ণনা শুনে তিনি দ্রুত মামলা লিখে ফেললেন। সেদিনই আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হলো।
কোর্টে খবর পৌঁছাতেই পরিস্থিতি বদলে গেল। বিচারক ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আসামি ও তিন মাতব্বরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেন। একইসঙ্গে মেয়েটিকে নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র- সেইফ হোমে রাখার আদেশ দিলেন।
আদালতের রায়ে সেদিনই মেয়েটি পুলিশের হেফাজতে তুলে দেওয়া হলো। চারপাশে ভিড় করা মানুষজন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। এতদিন ধরে যে গ্রামে সব অন্যায় টাকা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হতো, সেখানে আজ এক অসহায় কিশোরী আদালতের দ্বারে পৌঁছে সত্যের জন্য লড়াই শুরু করল।
বিদায় নেওয়ার সময় মেয়েটি সিথীর হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বললো, “আপা, আমি ভয় পাছে… কিন্তু আপনের চোখের ভেতর যে সাহস দেখি, তা আমারে বাঁচাইয়া রাখবো।”
সিথী মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ভয় পেও না। তোমার লড়াই এখন তোমার একার নয়, সবার। আমি আছি, আমরা আছি। যেখানে যা খরচ লাগবে আমি উকিল সাহেবের বিকাশে পাঠিয়ে দিব। ”
আরিফ পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “আজ আরো একটা উদাহরণ তৈরি হলো। কাল থেকে এই গ্রামে আর কেউ অন্যায়ের বিচার টাকায় মিটিয়ে দিতে সাহস পাবে না।”
আদালতের পরোয়ানা জারির পর স্থানীয় পুলিশ আর দেরি করল না। রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকা সেই ধর্ষক বাড়িওয়ালা ও সালিশদার তিন মাতব্বরকে ভোরবেলায় হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে আসা হলো। গ্রামে ও শহরে হৈচৈ পড়ে গেল। এতদিন যাদেরকে সবাই প্রভাবশালী ভেবে ভয় করত, সেদিন তাদেরকেই দেখা গেল পুলিশের জিপে মাথা নিচু করে বসে থাকতে।
সকালে খবর ছড়িয়ে পড়ল টিভি চ্যানেল, অনলাইন নিউজপোর্টাল আর জাতীয় দৈনিকগুলোতে। শিরোনাম হলো- “বাড়িওয়ালা কর্তৃক বুয়া ধর্ষণ : সাহসী তরুণী সিথীর হস্তক্ষেপে মামলা, চার আসামি গ্রেপ্তার”
চ্যানেলগুলোর ক্যামেরায় ধরা পড়ল সিথীর দৃঢ় কন্ঠ আর মেয়েটির ঝাপসা করে রাখা মুখ। প্রতিবেদকরা বারবার বলছিলেন, “যেখানে সমাজ চুপ থাকতে চেয়েছিল, নারীবাদী সিথী সেখানে দাঁড়িয়ে একজন তরুণী পুরো চিত্রটা বদলে দিলেন। নীরবতার দেয়াল ভেঙে দিলেন।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গেল। ফেসবুক, টুইটার আর ইউটিউবের ভিডিওতে সিথীর বক্তৃতার অংশ, তার সাহসী পদক্ষেপ ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে। হাজার হাজার মানুষ নিউজগুলোর নীচে মন্তবে লিখল,
“এমন মেয়ে আমাদের দেশের গর্ব।”
“সিথী আছে বলেই আমরা আশা করি, অন্যায় একদিন শেষ হবে।”
“নারীরা যদি চুপ না থাকে, তাহলে কোনো দানব টিকতে পারবে না।”
গ্রামে যারা আগে সিথীর দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল, তারাও ধীরে ধীরে মুখ খুলল। অনেকেই এসে বললো, “আমরা ভুল করেছি। এতদিন আমরা টাকাকে বিচার ভেবেছিলাম। আসলে ন্যায়বিচার টাকায় কেনা যায় না।”
আসামিদের গ্রেপ্তার জনমনে এক নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল। বিশেষ করে নারীদের মাঝে সাহসের সঞ্চার হলো। যেন সবার চোখে একটাই বার্তা, “যদি অন্যায় ঘটে, ভয় নয়- প্রতিরোধই হলো একমাত্র পথ।”
এদিকে সিথীও জানত, এই লড়াই এখানেই শেষ নয়। গণমাধ্যমের প্রশংসা, জনসমর্থনের ঢেউ- এসবের পাশাপাশি সামনে অপেক্ষা করছে আরো কঠিন পথ। কারণ প্রভাবশালীরা সহজে হার মানে না।
কিন্তু সেদিন রাতে সিথী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বললো, “আজকের উদ্যোগ শুধু এক মেয়ের নয়। এটা হলো সব নারীর নীরবতা ভাঙার প্রথম সোপান। আমি থামব না।”
তিনদিন পর আরিফের ফোনে কয়েকটা নোটিফিকেশন এলো। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের ছবি বিকৃত করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ ক্যাপশন। এ সময় তারা ফেনীতে একটি নারীকর্মশালা নিয়ে ব্যস্ত। কর্মশালায় ভিড়ের মধ্যে আরিফ সিথীর দিকে তাকাল, যেন কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। সিথী শুধু শান্ত স্বরে বললো, “আমি জানতাম এটা হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে পাল্টা লড়াই করব।”
এরপর তারা ঢাকায় ফিরে যায় এবং তাদের সংগঠনের টিম ডেকে নিল। একজন টেক-এক্সপার্ট জানাল, “ম্যাডাম, এই ভুয়া প্রোফাইলগুলোর আইপি ট্রেস করলে একটা নেটওয়ার্ক বের হয়ে আসবে। কিন্তু আপনাদের মানসিকভাবে দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ প্রথম ধাক্কায় মানুষ গুজবে বিশ্বাস করে।”
আরিফ বলল, “আমরা চুপ করে বসে থাকব না। লাইভে যাব, মানুষের সামনে সত্যিটা বলবো । তোমার ফলোয়ার প্রায় দেড় মিলিয়ন আর আমার পঞ্চাশ হাজার। দু’জনের মিলিয়ে দুই লক্ষ, যথেষ্ট।”
সেই রাতে ফেসবুক লাইভে সিথী ও আরিফ সরাসরি কথা বললো।
সিথী বললো, “আমাদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চলছে, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমি কোনোদিন ভয় পাইনি। যারা নারীদের ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে চায়, তাদের বলছি, ‘আমার কণ্ঠ কেউ থামাতে পারে নি এবং পারবেও না।”
লাইভটি ভাইরাল হলো। হাজার হাজার মানুষ কমেন্টে তাদের সমর্থন জানাল। এর মধ্যে সাংবাদিকরাও বিষয়টি কাভার করতে শুরু করল। “সাহসী দম্পতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র” শিরোনামে পরদিন জাতীয় বাংলা ও ইংলিশ পত্রিকায় খবর প্রকাশ হলো।
এদিকে কারাগারে বসেই শান্ত খবরটা পেল। ভেতরে তার রাগে চোখ লাল হয়ে উঠল। সে গর্জে উঠল, “ওরা ভাবছে, আমাকে হারাতে পারবে? এবার ওদের ভেতর থেকে ভাঙতে হবে।”
তার সহযোগী বাইরে থেকে পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করল। শুধু অনলাইন নয়, এবার তারা সিথী-আরিফের মাঠের কাজেও বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু সিথী প্রস্তুত ছিল। সে সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে প্রমাণ পাঠালো, কোন কোন ফেক প্রোফাইল থেকে অপপ্রচার হচ্ছে, কীভাবে ট্রল অ্যাকাউন্ট চালানো হচ্ছে। সাংবাদিকরা রিপোর্ট করল, “কারাগার থেকে অপরাধী শান্তর নির্দেশে অনলাইনে অপপ্রচার।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় এক নতুন হ্যাশট্যাগ উঠল, #সিথীরপাশে_জনগণ।
ঢাকার বেইলি রোডের একটি রেস্তোরাঁর অন্ধকার কোণে বসে আছে তিনজন যুবক। টেবিলের ওপারে মোবাইলের স্পিকার অন, ওপাশ থেকে কারাগারে থাকা শান্তর কণ্ঠ ভেসে আসছে।
শান্ত গর্জে উঠল, “অনলাইনে ওদের থামানো যায়নি। এবার রাস্তায় নামো। কোনোভাবে ওদের মধ্যে ভীতি তৈরি করো। একবার রক্ত দেখলে, আর আন্দোলন করার সাহস পাবে না।”
সহযোগীদের একজন দ্বিধায় বললো, “ভাই, ওরা এখন পুলিশের নজরে আছে। সরাসরি হামলা করলে ধরা খেয়ে যাব।”
শান্ত ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, “আমার নাম লিখবে না। তোমরা শুধু বার্তা পৌঁছে দাও, যে সিথীকে বাঁচাতে চাইবে, তার পরিণতিও খারাপ হবে।”
ওরা পরিকল্পনা করল, সিথী আরিফ যখন কোনো প্রজেক্টে গ্রামে যায়, তখন রাতে ফিরতে হয়। সেই সময় পথ আটকে হামলা করা হবে।
অন্যদিকে, সিথী-আরিফ তখনো বুঝতেই পারছিল না কতটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। এক সন্ধ্যায় তারা লক্ষীপুর একটি কলেজে প্রোগ্রাম শেষ করে ফেনী ফেরার পথে হাইওয়ের ধারে গাড়ি থামাল। হঠাৎ অন্ধকার থেকে মোটরসাইকেলে তিনজন মুখোশধারী এসে তাদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
একজন হাতে লোহার রড, আরেকজনের হাতে ধারালো চাকু। গর্জে উঠল, “তোমরা বেশি সাহসী বনে গেছ? আজ শিক্ষা দেব।”
আরিফ দরজা খুলে বেরোতেই সিথী চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে আরেকটি মোটরসাইকেল এসে দাঁড়াল, দুজন সাংবাদিক বন্ধু, যারা তাদের অনেক দিন থেকে ফলো করছিল খবর ও কর্মকান্ড সংগ্রহ করতে। সাংবাদিকরা ক্যামেরা অন করে লাইভে চলে গেল।
মুখোশধারীরা ক্যামেরা দেখে হতভম্ব। একজন গালাগালি করে বললো, “ক্যামেরা বন্ধ কর!”
কিন্তু ততক্ষণে লাইভে হাজারো মানুষ দেখছে। আরিফ দ্রুত সিথীকে গাড়িতে উঠিয়ে দরজা লক করে দিল, সাংবাদিকরা চেঁচিয়ে বললো, “এরা হামলাকারী! পুলিশে খবর দিন!”
লাইভ দেখে বেশ কয়েকজন স্থানীয় যুবক রাস্তায় বেরিয়ে এলো সিথীকে বাঁচাতে ও এক নজর দেখতে। ভয়ে সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কাছের চন্দ্রগঞ্জ পুলিশ দ্রুত এসে দুজনকে ধরে ফেলল।
পরদিন দেশের বড় বড় সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো, “সাইবার যোদ্ধা দম্পতির ওপর হামলার চেষ্টা, দুজন গ্রেপ্তার : পেছনে শান্তর হাতের অভিযোগ।”
কারাগারে বসে সংবাদপত্র হাতে শান্ত এবার আর চিৎকার করল না। তার চোখে জ্বলল ভিন্ন রকম আগুন,“খেলা এখনো শেষ হয়নি। এবার ভেতর থেকে নয়, বাইরের বড় খেলোয়াড়দের নামাতে হবে।”
পুলিশ হেফাজতে ধরা পড়া দুই হামলাকারী প্রথমে চুপ করে ছিল। কিন্তু রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন ভেঙে পড়ল। সে বলল, “আমরা শুধু নির্দেশ পালন করেছি। আসল মাথা জেলে বসেই সব চালাচ্ছে। নাম শান্ত… শান্ত মাহবুব।”
এই স্বীকারোক্তি সাথে সাথেই লিখিত জবানবন্দি হিসেবে আদালতে জমা হলো। তদন্ত কর্মকর্তারা অবাক, একজন কারাবন্দি কিভাবে বাইরে এত বড় নেটওয়ার্ক চালাচ্ছে!
পরদিন আদালতে বিষয়টি উত্থাপন হলে বিচারক পুলিশকে নির্দেশ দিলেন,“কারাগারের ভেতর থেকে কীভাবে যোগাযোগ হলো, তার পূর্ণ তদন্ত চাই। এবং আসামি শান্ত মাহবুবকে এ মামলায় প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে চার্জভুক্ত করা হবে।”
এ খবর শুনে সিথী আরিফ স্বস্তি পেলেও জানত, বিপদ এখনো শেষ হয়নি। সাংবাদিকরা তাদের ফেনীর বাসায় ছুটে এসে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সিথী দৃঢ়ভাবে বলল, “আমি আগেই বলেছিলাম, সত্য একদিন প্রকাশ হবেই। আমরা ভয় পাইনি, তাই প্রমাণও সামনে এসেছে। এখন ন্যায়বিচার চাই।”
জনগণের সমর্থন আরও বেড়ে গেল। সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়ল, #শান্তকে_শাস্তি_দাও।
এদিকে কারাগারের ভেতরে শান্ত তীব্র চাপে পড়ে গেল। জবানবন্দির খবর হাতে আসতেই সে চিৎকার করে উঠল, “সব কুকুর! আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আমি জেলেই পচে মরব।”
তদন্তের অংশ হিসেবে শান্তর কারাকক্ষ তল্লাশি করে পাওয়া গেল এক ছোট্ট মোবাইল ফোন, যার মাধ্যমে সে সহযোগীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করত। আরও ধরা পড়ল কিছু গোপন চিঠি, যেখানে হামলার পরিকল্পনার ইঙ্গিত ছিল।
সব প্রমাণ একসাথে জমা হওয়ায় পুলিশ এবার নতুন মামলা করল, “কারাগারে বসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে শান্তর বিরুদ্ধে মামলা।”
শান্তর নাম প্রকাশ্যে আসার সাথে সাথে তার পুরনো রাজনৈতিক আশ্রয়দাতারাও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। মিডিয়ায় চাপ বাড়তে থাকল, “শান্তকে কে বাঁচাচ্ছে?”
সিথী-আরিফ এবার আইনের লড়াইয়ে আরও শক্তিশালী হলো। তারা উকিলের মাধ্যমে আদালতে আবেদন করল, “শুধু শান্ত নয়, তার পুরো চক্রকে খুঁজে বের করতে হবে।”
বিচারক তদন্তকে প্রসারিত করার নির্দেশ দিলেন।
ফেনীর আদালতে শান্তর বিরুদ্ধে নতুন মামলা শুরু হওয়ার পর বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ল। বিবিসি, আল-জাজিরা, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন পোর্টাল রিপোর্ট প্রকাশ করল,
“বাংলাদেশে সাইবার অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সাহসী দম্পতি”
সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ #JusticeForSithi ট্রেন্ড হতে শুরু করল।
কয়েকদিন পর সিথীর হাতে একটি ইমেইল পৌঁছাল। পাঠিয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। চিঠিতে ইংরেজিতে লেখা,
“আপনার সাহস এবং সংগ্রাম আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা আপনাদের আইনি সহায়তা, সাইবার নিরাপত্তা প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রচারণায় সহযোগিতা করতে চাই। আপনি চাইলে শিগগিরই জেনেভায় অনুষ্ঠিত গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস কনফারেন্সে বক্তব্য দিতে পারেন। আপনার ও সাথে একজনের সকল ব্যয়ভার প্রতিষ্ঠান বহন করবে।”
চিঠি পড়ে আরিফের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, “দেখছো? তোমার সংগ্রাম শুধু এদেশেই নয়, বাইরেও আলো ছড়াচ্ছে।”
সিথীর কণ্ঠ গম্ভীর কিন্তু দৃঢ়, “এটা শুধু আমার গল্প নয়। আমি চাই পৃথিবী জানুক, একটি মেয়ে কীভাবে ভয়, অপমান আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যদের জন্য পথ দেখাতে পারে।”
কনফারেন্সে যাওয়ার আগে আন্তর্জাতিক টিমের প্রতিনিধি ঢাকায় এসে সিথী-আরিফের সাথে বৈঠক করল। তারা নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিশ্বমিডিয়ায় প্রচারণা চালাল।
একজন প্রতিনিধি বলল “আপনারা একা নন। এখন পৃথিবী আপনাদের গল্প শুনছে। শান্তর মতো অপরাধীরা যত শক্তিশালীই হোক, আন্তর্জাতিক চাপের সামনে তাদের টিকতে কষ্ট হবে।”
এই খবর শান্তর কানে পৌঁছাল কারাগারের ভেতরে। পত্রিকার পাতায় পড়ল, “আন্তর্জাতিক সমর্থন পেলেন সাহসী দম্পতি সিথী-আরিফ।”
শান্ত এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল, তারপর দাঁত চেপে ফিসফিস করে বলল, “আন্তর্জাতিক চাপ? দেখি, তারা কতদূর নিতে পারে।”
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহর। চারপাশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, কূটনীতিক, গবেষক, সবাই একত্রিত হয়েছে গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস কনফারেন্সে। হাজারো মানুষের ভিড়ে সিথী ও আরিফ যখন প্রবেশ করল, তখন করতালির ধ্বনি উঠল।
প্রথমেই সঞ্চালক তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, মঞ্চে আসছেন ফারজানা আকতার সিথী যিনি বাংলাদেশি নারী সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে তার অবিরাম সংগ্রাম, ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো এবং নতুন প্রজন্মকে সাহসী করে তোলার এক সাহসী যোদ্ধা।
সিথী মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে চারপাশের ভিড়ের দিকে তাকাল। তারপর কণ্ঠ ছেড়ে দৃঢ়ভাবে ইংরেজিতে বললো,
“একসময় আমার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল ছবির ভেতর। আজ আমি বেঁচে আছি শব্দের ভেতর। আমি জানি, লজ্জার দেয়াল ভেঙে দাঁড়ানো কতটা কষ্টের। কিন্তু আমি শিখেছি—লড়াই না করলে পরের প্রজন্মও ভুক্তভোগী হবে। তাই আমি ভয় পাই না।”
কনফারেন্স হল নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এরপর সিথী বললো,
“আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, যেখানে অনেক নারী এখনো সাইবার অপরাধের শিকার। আমি চাই, আপনারা শুধু করতালি নয়, আমাদের মতো ভুক্তভোগীদের জন্য প্রযুক্তি, আইন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা দিন।”
তার বক্তৃতার শেষে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল সবাই। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম পরদিন শিরোনাম করল—
“From Victim to Global Voice: Bangladeshi Woman Stands Against Cyber Violence.”
আরিফও পরে বলল, “আমি একজন স্বামী হিসেবে শুধু আমার স্ত্রীর নয়, দেশের প্রতিটি মেয়ের নিরাপত্তার লড়াই করছি। আমরা দেখেছি, অপরাধীরা শুধু কারাগারে নয়, সমাজেও প্রভাব বিস্তার করে। তাই এই লড়াই বৈশ্বিক হতে হবে।”
সেদিন কনফারেন্স শেষে একাধিক সংস্থা তাদের সাথে সহযোগিতার ঘোষণা দিল। কেউ বললো আইনি সহায়তা দেবে, কেউ আধুনিক সাইবার সুরক্ষা প্রশিক্ষণ দেবে, আবার কেউ অর্থনৈতিক অনুদান ঘোষণা করল।
বাংলাদেশে ফিরে আসার পর সিথী-আরিফকে বিমানবন্দরে শত শত তরুণ-তরুণী ফুল দিয়ে বরণ করল।
একজন কিশোরী চোখে অশ্রু নিয়ে বলল, “আপু, আপনি না থাকলে আমি হয়তো আজ বাঁচতাম না।”
সেদিন সিথীর চোখে অশ্রু ঝলমল করল, কিন্তু মুখে শুধু একটু মৃদু হাসি একটি কথা, “এ লড়াই আমার একার নয়, আমাদের সবার।”
জেনেভা কনফারেন্স থেকে ফেরার পর সিথী-আরিফ দেশের মানুষের চোখে শুধু “সাহসী দম্পতি” নয়, হয়ে উঠল এক আশার প্রতীক। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল—সবখান থেকেই তাদের আমন্ত্রণ আসতে লাগল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক সমাবেশে সিথী বলল, “সাইবার অপরাধ শুধু আমার একার বিরুদ্ধে হয়নি। প্রতিদিন শত শত নারী, কিশোরী একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় আলাদা আইন, আলাদা ট্রাইব্যুনাল, আর দ্রুত বিচার।”
কণ্ঠে আগুন, চোখে অশ্রু, তার ভাষণ শেষ হতে না হতেই হাজারো তরুণ-তরুণী মশাল জ্বালিয়ে স্লোগান তুলল, “সাইবার সন্ত্রাসের বিচার চাই, এখনই চাই!”
এরপর কয়েক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলায় “সাইবার নিরাপত্তা মিছিল” শুরু হলো। নারীরা, শিক্ষার্থীরা, এমনকি অনেক অভিভাবকও তাতে যোগ দিল।
আরিফ বললো, “এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। এটা মানুষের নিরাপত্তার আন্দোলন।”
গণমাধ্যম প্রতিদিন খবর প্রকাশ করল, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়ল, #সাইবারআইন_এখনই ।
চাপ এতটাই বেড়ে গেল যে জাতীয় সংসদে বিষয়টি আলোচনা শুরু হলো। একজন তরুণ এমপি দাঁড়িয়ে বললেন “আমরা যদি নতুন প্রজন্মকে সুরক্ষা না দিই, তাহলে তাদের স্বপ্ন কেবল ভয় আর ব্ল্যাকমেইলের ভেতরে আটকে যাবে। সাইবার অপরাধের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন হোক।”
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সংসদে স্মারকলিপি জমা দিল, আর আইন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো নতুন আইনের খসড়া তৈরির।
শান্ত কারাগারে বসে এই খবর পড়ল। পত্রিকায় শিরোনাম, “সাইবার অপরাধ দমনে নতুন আইন আসছে, প্রেরণা সিথী-আরিফ।”
সে দেয়ালে ঘুষি মেরে চিৎকার করে উঠল, “ওরা শুধু আমাকে হারাচ্ছে না, আমার সাম্রাজ্যও ভেঙে দিচ্ছে।”
তার চোখে তখন শুধু প্রতিশোধের আগুন।
জাতীয় সংসদ ভবন সেদিন ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। তথ্য ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে উত্থাপিত হলো নতুন বিল, “সাইবার সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও ভুক্তভোগী সুরক্ষা আইন ২০২৫”
বিলে উল্লেখ ছিল—
- সাইবার অপরাধের জন্য আলাদা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।
- ভুক্তভোগীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
- কারাগার থেকে অপরাধ চালানোর ঘটনা প্রতিরোধে ডিজিটাল মনিটরিং সেল তৈরি হবে।
সংসদে করতালির ঝড় উঠল। স্পীকার বললেন, “এটা শুধু একটি আইন নয়, এটা আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার ঘোষণা । বিলটি পাশ করা হলো।
বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হলো।
সংসদে বিল পাশ হওয়ার সাথে সাথে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম দ্রুত শুরু হয়ে গেল। সবার চোখ ছিল শান্ত মাহবুবের পরের মামলার দিকে।
প্রমাণ ইতিমধ্যেই জমা হয়েছিল—
- জবানবন্দিতে সহযোগীদের নামফাঁস।
- কারাগারে মোবাইল ফোনসহ ধরা পড়া।
- সাইবার হামলার পরিকল্পনার চিঠি।
আদালতে বিচারক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “একজন কারাবন্দি হয়েও সে সমাজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছে। আইন ভাঙার সাহস দেখিয়েছে। তাই এ মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।”
রায় ঘোষণা হলো, ‘’শান্ত মাহবুবকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
রায় শোনার পর আদালতের বাইরে সিথী-আরিফ সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়াল।
সিথীর চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু কণ্ঠ দৃঢ়, “এবারের রায়টিও শুধু আমার জন্য নয়। প্রতিটি মেয়ের জন্য, যারা একদিন ভেবেছিল ‘জীবন শেষ’। আজ প্রমাণ হলো, অপরাধী যত শক্তিশালী হোক, ন্যায়বিচার শেষমেষ জয়ী হয়।”
মানুষের ভিড় থেকে গর্জে উঠল স্লোগান, “সিথী-আরিফ, তোমাদের সালাম!”
এই রায়ের পর দেশজুড়ে আন্দোলন যেন আরও শক্তি পেল। নতুন আইনের অধীনে কয়েক মাসের মধ্যেই সারাদেশে ডজনখানেক সাইবার অপরাধী গ্রেপ্তার হলো।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রিপোর্ট করল, “বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমনে ঐতিহাসিক অগ্রগতি।”
আর সিথী-আরিফ? তারা শুধু কর্মী নয়, হয়ে উঠল এই প্রজন্মের অনুপ্রেরণা।
রায়ের পর কয়েক মাস কেটে গেল। দেশে নতুন সাইবার ট্রাইব্যুনাল গড়ে উঠল, ভুক্তভোগীরা আশার আলো দেখতে শুরু করল। সিথী-আরিফ এক মুহূর্তও থেমে থাকল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশাল সমাবেশে তরুণ-তরুণীদের সামনে দাঁড়িয়ে আরিফ বলল—
“আমরা একদিন শুধু দু’জন মানুষ ছিলাম, আজ হাজারো মানুষ এই মশাল হাতে নিয়েছে। মনে রেখো, পরিবর্তন কখনো একা আসে না, সাহসী কণ্ঠই পরিবর্তন ডেকে আনে।”
সিথী মঞ্চে উঠে বলল, “আমি একসময় ভেবেছিলাম, আমার জীবন শেষ। কিন্তু আজ আমি জানি, কোনো ভয়, কোনো অপমান, কোনো অপরাধীর হাত আমাদের স্বপ্ন শেষ করতে পারে না। তোমরা সবাই আমার মতো লড়াই করতে পারবে।”
সেই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলো। গ্রামে-গঞ্জে কিশোরীরা বলল, “আমরা সিথী আপুর মতো হতে চাই।”
অল্পদিনেই সিথী-আরিফ একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলল, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আন্দোলন”
এ সংগঠনের কাজ হলো,
- স্কুল-কলেজে সাইবার সচেতনতা কর্মশালা।
- ভুক্তভোগীদের জন্য ২৪৭ হেল্পলাইন।
- আইন প্রণয়নে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের ফান্ড ও প্রযুক্তি দিল। সরকারও সহযোগিতা শুরু করল।
সিথী এখন রাস্তায় বের হলে শত শত নারী-পুরুষ তাকে ঘিরে ধরে। তার সাথে সেলফি তুলে আনন্দ পায়। সিথী ছোট-বড় সবাইকে একটা উপদেশ দেয়, ‘’লজ্জা নয়, সাহস নিয়ে চলতে শিখ। সাহস মানেই ভয় নয়, ভয়কে জয় করা।
এক সন্ধ্যায় ছাদে দাঁড়িয়ে আরিফ সিথীর হাত ধরে বললো, “তুমি খেয়াল করেছো? আমরা শুধু নিজেদের জীবন বাঁচাইনি, হাজারো জীবনের আশাও জাগিয়েছি।”
সিথী হাসল, চোখে অশ্রু চিকচিক করল। “এটা আমাদের ভালোবাসার জয়। ভালোবাসা যদি সত্য হয়, তবে সেটা শুধু দু’জনের নয়, পুরো সমাজকে বদলে দিতে পারে।”
আইন পাশ হওয়া, শান্তর দণ্ড এবং নতুন প্রজন্মকে নিয়ে আন্দোলনের পর ৬ মাস কেটে গেছে। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আন্দোলন” এখন আলোচনার শীর্ষে।
প্রতিদিন দেশের গ্রামে-গঞ্জে শত শত নারী সেই সংগঠনের হেল্পলাইনে কল দিচ্ছে, পাচ্ছে আইনি পরামর্শ ও মানসিক সহায়তা। আর তরুণরা স্কুল-কলেজে সাইবার সচেতনতার ব্যানার নিয়ে মিছিল করছে।
এক সকালে সিথী-আরিফ ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণ পর সাংবাদিক বন্ধু ফোন দিলেন।
“অভিনন্দন সিথী আপা! খবর দেখেছেন?”
সিথী হতবাক, “কোন খবর?”
বন্ধুটি বলল, “নরওয়ের নোবেল কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আপনার নাম আন্তর্জাতিক তালিকায় উঠে এসেছে।”
খবরটি মুহূর্তেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান শিরোনাম করল, “Bangladeshi Survivor Turned Activist Nominated for Nobel Peace Prize.”
ঢাকার রাস্তায় মিছিল বের হলো, পোস্টারে লেখা, “আমাদের গর্ব, সিথী।” শিশুরা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিল, “সাইবার অপরাধ মুক্ত বাংলাদেশ চাই।”
সেদিন রাতে সিথী-আরিফ ছাদে বসে ছিল। চারপাশে তারাভরা আকাশ। হঠাৎ আরিফ সিথীকে টেনে কয়েক সেকেন্ড বুকে জড়িয়ে রাখলেন, তারপর মুখের দু’পাশে অনবরত চুমো দিয়ে যাচ্ছেন। সিথী চরম একটা অনুভূতিতে শিহরিত হয়ে যায়। তার কন্ঠ, দৃষ্টিশক্তি ও শরীরটা কেমন যেন নীমিলিত হয়ে যায়।
আরিফ মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছো? গ্রামের এক সাধারণ মেয়ে থেকে আজ তুমি নোবেল মনোনীত।”
সিথী আরিফের দু’হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে বলল, “এটা আমার নয়, এটা প্রতিটি মেয়ের জয়, যারা ভেবেছিল অপমানের পর আর জীবন নেই। আমি চাই নোবেলের মঞ্চ থেকেও শুধু সেই কথাটা বলতে, ‘ভয়কে জয় করো, জীবন বেছে নাও।’”
এরপর থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই সিথী হয়ে উঠল এক নতুন প্রজন্মের প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, নারীর অধিকার রক্ষা, এবং ডিজিটাল যুগে মানবতার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।
নরওয়ের অসলো সিটি হলে ঝলমলে এক আয়োজন। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক, রাষ্ট্রপ্রধান, কূটনীতিক আর মানবাধিকার কর্মীদের ভিড়।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান যখন মঞ্চে উঠলেন, সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। তিনি বললেন, “এই বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি নারী ফারজানা আকতার সিথীকে। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে তার অবিরাম সংগ্রাম, ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো এবং নতুন প্রজন্মকে সাহসী করে তোলার জন্য তিনি আজ বিশ্বশান্তির প্রতীক।”
অসলো সিটি হলে বজ্রধ্বনির মতো করতালি উঠল।
সাদা শাড়ি, মাথায় হালকা নীল ওড়না, সাদামাটা সাজে মঞ্চে উঠলেন সিথী। তার হাতে ফুল, চোখে অশ্রু।
মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বললেন, “আজ আমি একা দাঁড়াইনি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিটি নারী, প্রতিটি কিশোরী, যারা ভয়কে জয় করেছে।”
তিনি থামলেন, চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তারপর বললেন, “আমি একসময় ভেবেছিলাম আমার জীবন শেষ। কিন্তু অপমানকে পরাজিত করে আমি আবার দাঁড়িয়েছি। আমি শুধু চাই, পৃথিবীর কোনো মেয়ে যেন কখনো নিজের জীবন শেষ করার কথা না ভাবে।”
তার কণ্ঠ ভেঙে গেল, কিন্তু দৃঢ়তা আরও স্পষ্ট হলো, “ভালোবাসা, ন্যায়বিচার আর সাহস—এগুলোই প্রকৃত শান্তি গড়ে তোলে। আমি চাই, বাংলাদেশ থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন একদিন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে পৌঁছাক।”
শেষ বাক্য, “আমার এ নোবেল, প্রতিটি ভুক্তভোগী মেয়ের নোবেল।”
প্যান্ডেল ভর্তি লোকজন দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল। চোখে পানি নিয়ে আরিফ মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিল।
জাতিসংঘের মহাসচিব সেই রাতে টুইটে লিখলেন, ‘’সিথীর জয় মানবতার জয়।‘’
বাংলাদেশের মাটিতে রাস্তায় লাখো মানুষ মিষ্টি বিতরণ করল। স্কুল কলেজের মেয়েরা স্লোগান দিল, ‘’আমরা সিথীর পথে হাটবো, উৎপীড়ককে ঘাড় চেপে মারবো।
সিথী-আরিফ ফিরে এলেন দেশে। দীর্ঘ আকাশযাত্রার পর বিমানের দরজা খুলতেই যেন আলোকমালা ছড়িয়ে পড়ল। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল হাজারো পতাকা, আর মানুষের কণ্ঠে গর্জে উঠছিল এক অনন্ত ধ্বনি, “সিথী, সিথী, আমাদের গর্ব সিথী!
ম্লান ক্লান্তি ছাপিয়ে তার চোখে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত দীপ্তি। হাতে নোবেল মেডেল, বুকভরা বাংলাদেশ। চারপাশের উচ্ছ্বাস তাকে মুহূর্তেই ভুলিয়ে দিল বিদেশের আনুষ্ঠানিকতার গাম্ভীর্য। এই ছিল তার আপন মানুষ, এই ছিল তার মাটি।
লাল গোলাপের স্রোতে ভেসে গেল বিমানবন্দরের পথ। ছোট্ট শিশুরা রঙিন ফিতা উড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, নারী-পুরুষ সবাই গোলাপের পাঁপড়ি ছুঁড়ছেন, বৃদ্ধেরা হাত তুলে দোয়া করলেন। সিথীর চোখ অশ্রুতে ভিজে উঠল, এই ভালোবাসাই তার সবচেয়ে বড় পুরষ্কার।
পরদিন বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সংবর্ধনা। চারদিক মানুষের সমুদ্র, কেউ গাছে চড়েছে, কেউ ছাদে দাঁড়িয়ে। বাতাসে লাল-সবুজের তরঙ্গ। মঞ্চে উঠতেই সবার কণ্ঠে একযোগে ধ্বনি উঠল, “শান্তির দূত সিথী—বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর।”
মঞ্চের আলোর নিচে সিথী দাঁড়িয়ে যেন রূপকথার এক নায়িকা। তিনি তার বক্তব্য শুরু করলেন বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে। এরপর বললেন,
মাননীয় রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, প্রিয় সহকর্মী, এবং আমার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, আপনাদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
আজ আমি যে সম্মান নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি, তা আসলে আমার ব্যক্তিগত অর্জন নয়—এটি বাংলাদেশের প্রতিটি নারী, প্রতিটি তরুণ, প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত শক্তির স্বীকৃতি।
একসময় আমি নিজেও সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছিলাম। সমাজ আমাকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। আমি বিশ্বাস করেছি, যে অন্যায় সহ্য করে, সে-ই অন্যায়ের অংশীদার হয়ে যায়। তাই আমি প্রতিবাদ করেছি, লড়াই করেছি, এবং সেই লড়াইয়ে অসংখ্য মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
আজ আমি এই নোবেল শান্তি পদক হাতে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, এটি আমার নয়, এটি নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামে বসে থাকা সেই কিশোরীর, যে প্রথমবার সাহস করে থানায় অভিযোগ জানিয়েছিল; এটি ফেনীর সেই শিক্ষার্থীর, যে স্কুলে গিয়ে সহপাঠীদের সাইবার নিরাপত্তা শেখাচ্ছে; এটি ঢাকার সেই তরুণের, যে বন্ধুদের নিয়ে অনলাইনে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই পদককে শুধু প্রদর্শনীতে ঝুলিয়ে রাখব না। এটি হবে আমাদের সাইবার নিরাপত্তা আন্দোলনের প্রতীক। এটি হবে নারীর সম্মান রক্ষার শপথের প্রতীক। এটি হবে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সাহস ও স্বপ্নের প্রতীক।
আমি চাই, আগামী দিনে বাংলাদেশকে কেউ আর ভুক্তভোগীর দেশ বলবে না, বরং যোদ্ধাদের দেশ বলবে। আমি চাই, প্রতিটি নারী জানুক, তারা একা নয়। তারা শক্তি, তারা আলো, তারা পরিবর্তনের অগ্রদূত।
আমার শেষ কথা, ‘’নোবেল আমার হাতে আসা একটি সম্মান, কিন্তু মানুষের ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার।‘’
সবাইকে ধন্যবাদ। সংবর্ধনার মঞ্চ থেকে যখন তিনি নেমে এলেন, আকাশে তখন লাল-সবুজ কাগজের পাখি উড়ছিল। সেদিনের সূর্যাস্ত যেন ঘোষণা করছিল—বাংলাদেশের ইতিহাসে যোগ হল নতুন এক আলোকিত অধ্যায়।
মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই এক ছোট মেয়ে ফুল হাতে এগিয়ে এলো। বলল, “আপু, তুমি আমাদের হিরো।”
সিথী তাকে বুকে টেনে নিল, অশ্রুভেজা হাসি নিয়ে বলল, “না মা, তুমি-ই আসল হিরো। তোমাদের জন্যই আমি বেঁচে আছি।”
রাস্তায় ছুটে আসা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে সিথীর দিকে ইশারা করে বললো, “নোবেল আপু, আমি তোমার মতো সাহসী হব।”
সিথীর চোখে অশ্রু, মুখে হাসি, “না, তুমি নিজেই সাহসী। আমি শুধু তোমাকে পথ দেখাচ্ছি।”
উপরের আকাশে রঙিন বেলুন, আতশবাজি ফেটে উঠল। হাজারো মানুষের চোখে একসাথে আনন্দ আর গর্বের অশ্রু ঝলমল করল। মানুষের হাসি, ঢাকঢোল, পুরো বাংলাদেশ যেন এক সঙ্গীতময় আনন্দে ভেসে উঠল।